সাহিত্য
লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল ও বর্তমানের মহাপ্রলয়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ৮:১৬:২৪ অপরাহ্ন
আরণ্যক শামছ :
স্টকহোম থেকে যখন সুইডিশ অ্যাকাডেমির সচিবের কণ্ঠে ভেসে এলো হাঙ্গেরীয় লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের নাম, তখন যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষার এক অমোঘ উপসংহার রচিত হলো। এ পুরস্কার অপ্রত্যাশিত ছিল না; বরং বহু বছর ধরে সাহিত্যপ্রেমী ও বোদ্ধা মহলে তাঁর নাম ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। একে ঠিক পুরস্কার বলা চলে না, এ যেন এক অনিবার্য স্বীকৃতি। স্বীকৃতি সেই লেখকের, যিনি ভাষার প্রচলিত সীমানাকে ভেঙেচুরে, দাঁড়ি-কমার তোয়াক্কা না করে এক অনন্ত বাক্যের গোলকধাঁধায় আমাদের এই ভাঙাচোরা পৃথিবীর করুণ কিন্তু পবিত্র মুখচ্ছবি এঁকে চলেছেন। তাঁর নোবেল প্রাপ্তির পর পুনরায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে এসেছে তিন বছর আগে, ২০২২ সালে, ‘দ্য ইয়েল রিভিউ’-তে সাংবাদিক ও লেখক হরি কুঞ্জরুকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারটি। আজ পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, সেই সাক্ষাৎকারটি ছিল এক ভবিষ্যদ্বাণী, যেখানে ক্রাসনাহোরকাই তাঁর সমগ্র সাহিত্যিক দর্শন এবং যে কারণে তিনি আজ এই সম্মানে ভূষিত হলেন, তার নির্যাসটুকু মেলে ধরেছিলেন। সেই কথোপকথনটিই যেন হয়ে উঠেছে তাঁর নোবেল প্রাপ্তির যৌক্তিকতার সবচেয়ে বড় সনদ।
হরি কুঞ্জরুর সঙ্গে সেই আলাপচারিতায় ক্রাসনাহোরকাই যে বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়েছিলেন, তা কেবল তাঁর সাহিত্যকর্মের মূল সুরকেই তুলে ধরে না, বরং একুশ শতকের এই বিক্ষুব্ধ সময়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের অস্তিত্বের সংকটকেও নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করে। সাক্ষাৎকারের পটভূমি ছিল ইউক্রেনের যুদ্ধ, যা তাঁর গল্প “অহ অহমবষ চধংংবফ অনড়াব টং”-এর প্রেরণা। গল্পটি দুজন মুমূর্ষু সৈন্যকে নিয়ে, যারা যুদ্ধের এক কর্দমাক্ত পরিখায় শুয়ে আছে। একজন সৈন্য আরেকজনকে শোনাচ্ছে প্রযুক্তিগত বিশ্বায়নের এক রূপকথার গল্প, যেখানে মঙ্গল গ্রহে ভ্রমণের মতো অলীক স্বপ্নেরা ভিড় করে। এই চরম বৈপরীত্যের মধ্য দিয়েই ক্রাসনাহোরকাই আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় ভণ্ডামিটিকে উন্মোচিত করেন। একদিকে বিংশ শতাব্দীর মতোই পাশবিক এক যুদ্ধ, যেখানে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে; অন্যদিকে ডিজিটাল ইউটোপিয়ার এক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, যা আমাদের বর্তমানের ভয়াবহতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে প্রলুব্ধ করে। ক্রাসনাহোরকাইয়ের কাছে এই পরিস্থিতি এক ‘সম্পূর্ণ পাগলামি’। তাঁর এই তীব্র প্রতিক্রিয়া কেবল একজন সংবেদনশীল শিল্পীর নয়, বরং একজন গভীর ইতিহাস-সচেতন দার্শনিকেরও বটে। তিনি যখন হাঙ্গেরির অরবান সরকারের ‘তথাকথিত নিরপেক্ষতা’কে এক ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত ঘটনা’ বলে অভিহিত করেন, তখন তাঁর কণ্ঠের দৃঢ়তা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিল্পের দায় কেবল সৌন্দর্যের প্রতি নয়, সত্যের প্রতিও। যে দেশ নিজেই ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে রাশিয়ার মতো শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, সেই দেশ যখন প্রতিবেশীর আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় নিরপেক্ষতার ভান করে, তখন তাকে কপটতা ছাড়া আর কী বলা যায়? এই রাজনৈতিক অবস্থান তাঁর সাহিত্যকে এক নৈতিক কাঠিন্য দান করেছে। তিনি সেই সব লেখকদের দলে নন, যারা নিরাপদ দূরত্বে থেকে শিল্পের চর্চা করেন; তিনি ইতিহাসের চলমান নরকের সাক্ষী এবং তাঁর প্রতিটি অক্ষর সেই সাক্ষ্যের ভার বহন করে।
এই সাক্ষাৎকারেই ক্রাসনাহোরকাই তাঁর সেই বিখ্যাত ধারণাটির পুনরুচ্চারণ করেন, যা তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মের গভীরে প্রোথিত- মহাপ্রলয় বা অ্যাপোক্যালিপ্স কোনো ভবিষ্যৎ ঘটনা নয়, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। “ঞযব ধঢ়ড়পধষুঢ়ংব রং হড়”ি -তাঁর এই উক্তিটি আজ বিশ্বজুড়ে অনুরণিত হচ্ছে। আমরা কোনো মহাপ্রলয়ের জন্য অপেক্ষা করছি না, আমরা এর মধ্যেই বাস করছি। এই ধীর, নিষ্পেষণকারী, অন্তহীন সংকটই আমাদের বর্তমান। ভবিষ্যৎ হলো আশার এক মরীচিকা, যা কখনোই আসে না। আর অতীত? অতীত হলো বর্তমানের তৈরি করা এক গল্প মাত্র। অস্তিত্বশীল কেবল এই বর্তমান, যেখানে স্বর্গ ও নরক দুই-ই উপস্থিত। এই দর্শনই ক্রাসনাহোরকাইকে সমসাময়িক অন্য লেখকদের থেকে পৃথক করে। যেখানে অনেকেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন বা অতীতের স্মৃতিচারণে আশ্রয় খোঁজেন, সেখানে তিনি এক অসীম সাহসিকতায় বর্তমানের মুখোমুখি দাঁড়ান। তাঁর উপন্যাসের জগৎ- তা সে ঝধঃধহঃধহমড়-র বৃষ্টিভেজা, কর্দমাক্ত হাঙ্গেরীয় গ্রাম হোক বা ঞযব গবষধহপযড়ষু ড়ভ জবংরংঃধহপব-এর বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত শহর হোক, সব-ই যেন এই চলমান মহাপ্রলয়েরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ। তাঁর চরিত্রেরা কোনো ত্রাণকর্তার জন্য অপেক্ষা করে না, কারণ তারা জানে কোনো ত্রাণকর্তা আসবে না। তারা কেবল এই অন্তহীন বর্তমানে টিকে থাকার সংগ্রাম করে যায়।
এই দর্শনই তাঁর গদ্যশৈলীকে নির্মাণ করেছে। তাঁর বিখ্যাত সেই অখণ্ড, দীর্ঘ বাক্য, যা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে চলতে থাকে, তা কোনো শৈলীগত বিলাসিতা নয়, বরং তাঁর বিশ্ববীক্ষার এক অনিবার্য প্রকাশ। সাক্ষাৎকারের পটভূমিতে হরি কুঞ্জরু যেমনটা উল্লেখ করেছিলেন, ক্রাসনাহোরকাইয়ের মতে পূর্ণচ্ছেদ বা দাঁড়ি ‘ঈশ্বরের অধিকারে’। মানুষের অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে ভালোবাসা, যন্ত্রণা বা অস্তিত্বের গভীর উপলব্ধিগুলো ছোট ছোট খণ্ডিত বাক্যে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাঁর বাক্যপ্রবাহ অনেকটা নদীর স্রোতের মতো, যা পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এই স্রোত আধুনিকতাবাদী ‘চেতনাপ্রবাহ’ নয়, যেখানে লেখকের খণ্ডিত ভেতরের জগত উন্মোচিত হয়; বরং এ হলো জগৎ সম্পর্কে এক সর্বগ্রাসী কৌতূহল, যা দর্শন, হাস্যরস, জাগতিকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে একাকার করে দেয়। তাঁর বাক্য পড়তে গিয়ে পাঠক এক সম্মোহনী ঘোরে প্রবেশ করে। এই ঘোর আরামদায়ক নয়; এটি প্রায়শই ক্লান্তিকর, দমবন্ধকর, কিন্তু একই সাথে এটি পাঠককে বাস্তবতার এমন এক গভীর স্তরে পৌঁছে দেয়, যেখানে সাধারণ গদ্য পৌঁছাতে পারে না। তাঁর বাক্য ঠিক যেন জীবনের মতোইÍজটিল, অপ্রত্যাশিত এবং সমাপ্তিহীন। এই অন্তহীন বাক্যই হলো সেই অন্তহীন বর্তমানের শৈল্পিক প্রতিরূপ, যেখানে আমরা সবাই বন্দি।
ঝধঃধহঃধহমড় বা ঞযব গবষধহপযড়ষু ড়ভ জবংরংঃধহপব-এর মতো তাঁর প্রারম্ভিক উপন্যাসগুলোতে এই দমবন্ধকর পরিস্থিতি প্রায় অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পূর্বেকার হাঙ্গেরির প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসগুলোতে চরিত্ররা যেন এক অদৃশ্য খাঁচায় বন্দি। তারা অপেক্ষা করে, ষড়যন্ত্র করে, স্বপ্ন দেখে, কিন্তু তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা এক নিষ্ফল চক্রে আবর্তিত হতে থাকে। ঝধঃধহঃধহমড়-তে এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের খামারের বাসিন্দারা ইরিমিয়াস নামের এক রহস্যময় ব্যক্তির আগমনের জন্য অপেক্ষা করে, যাকে তারা তাদের ত্রাণকর্তা বলে মনে করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই তথাকথিত মসিহা তাদের আরও গভীর হতাশায় নিমজ্জিত করে চলে যায়। এখানে আশা এক ভয়ঙ্কর প্রতারণা। ক্রাসনাহোরকাইয়ের জগতে আশাই হয়তো সবচেয়ে বড় পাপ, কারণ তা আমাদের বর্তমানের মুখোমুখি হতে বাধা দেয়। তাঁর সাহিত্য আমাদের এটাই শেখায় যে, মিথ্যা আশা বা অলীক ভবিষ্যতের স্বপ্ন আমাদের মুক্তি দেবে না; মুক্তি যদি কোথাও থাকে, তবে তা এই ভাঙাচোরা, কর্দমাক্ত বর্তমানকে নির্মোহভাবে স্বীকার করার মধ্যেই নিহিত।
তবে তাঁর জগৎ কেবলই হতাশায় পরিপূর্ণ নয়। সাক্ষাৎকারে তিনি শিল্পের ভূমিকা নিয়ে যে কথাগুলো বলেছেন, তা এক ভিন্ন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। তাঁর মতে, ‘শিল্প হলো সেই দিশেহারা অনুভূতির প্রতি মানবতার অসাধারণ প্রতিক্রিয়া যা আমাদের নিয়তি।’ বিশেষ করে তাঁর পরবর্তীকালের কাজ, যেমন ঝবরড়নড় ঞযবৎব ইবষড়-িতে, এই ভাবনাটি মূর্ত হয়ে উঠেছে। এই উপন্যাসে তিনি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিল্পকর্মের সৃষ্টি ও সংরক্ষণের মুহূর্তগুলোকে তুলে ধরেছেন। ভেনিসের এক চিত্রকর থেকে শুরু করে জাপানের এক মাস্ক নির্মাতা- তাঁরা সবাই সৌন্দর্যের উপাসক।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের কাছে সৌন্দর্য এক অধরা, প্রায় ঐশ্বরিক বস্তু। আমরা তাকে স্পর্শ করতে পারি না, কেবল তার অস্তিত্বকে দূর থেকে স্বীকার করতে পারি। এই সৌন্দর্যই হয়তো এই মহাপ্রলয়ের পৃথিবীতে একমাত্র পরিত্রাণের পথ। এটি কোনো সহজ পরিত্রাণ নয়; এ হলো সেই কঠোর সাধনা, যা শিল্পীকে করতে হয়, বা সেই নিমগ্ন অবলোকন, যা দর্শককে করতে হয়। শিল্প পৃথিবীকে বদলে দেয় না, কিন্তু এটি এই নরকের মধ্যেও স্বর্গের অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সমস্ত ধ্বংস এবং বিশৃঙ্খলার পরেও এমন কিছু একটা আছে, যা পবিত্র এবং শাশ্বত। এই বোধই ক্রাসনাহঙ্করাইয়ের মানবতাবাদের মূল ভিত্তি। তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যেই এই পবিত্রতার সন্ধান করেন।
সাক্ষাৎকারের শেষে তিনি যেমনটা বলেছিলেন, ‘কেবল সাধারণ মানুষেরই অস্তিত্ব আছে। এবং তারা পবিত্র।’ তাঁর সাহিত্যের মহাবিশ্বে এই সাধারণ, পরাজিত, দিশেহারা মানুষগুলোই নায়ক। তাদের ব্যর্থতা, তাদের ছোট ছোট আশা এবং তাদের অন্তহীন অপেক্ষার মধ্য দিয়েই মানব অস্তিত্বের করুণ মহাকাব্য রচিত হয়। আর এই মহাকাব্য রচনার জন্যই লাসলো ক্রাসনাহোরকাই আজ বিশ্বের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মানে ভূষিত।
তাঁর এই নোবেল প্রাপ্তির পর সুইডিশ অ্যাকাডেমির ঘোষণাপত্রটি যেন ‘দ্য ইয়েল রিভিউ’-এর সেই সাক্ষাৎকারেরই এক প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিধ্বনি। অ্যাকাডেমি তাঁর সম্মাননায় উল্লেখ করেছে, ‘সেই লেখকের জন্য, যিনি এক অখণ্ড ও সম্মোহনী গদ্যে বর্তমানের অধিবিদ্যাগত শূন্যতাকে উন্মোচিত করেছেন এবং মানব অস্তিত্বের ভঙ্গুর কিন্তু পবিত্র মুহূর্তগুলোকে উদ্ধার করেছেন এক চলমান মহাপ্রলয়ের পটভূমিতে।’ এই ঘোষণায় ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দ- ‘অখণ্ড গদ্য’, ‘বর্তমান’, ‘মহাপ্রলয়’, ‘পবিত্র মুহূর্ত’- সরাসরি ক্রাসনাহোরকাইয়ের দর্শনের কেন্দ্র থেকে উঠে এসেছে। অ্যাকাডেমি বিশেষভাবে তাঁর গদ্যের সেই ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছে, যা পাঠককে এক অস্বস্তিকর কিন্তু জরুরি যাত্রায় সঙ্গী করে, যেখানে পরিচিত পৃথিবীর কাঠামো ভেঙে পড়ে এবং এক গভীরতর, প্রায় আধ্যাত্মিক সত্যের মুখোমুখি হতে হয়। নোবেল কমিটির এই পর্যবেক্ষণ নতুন কিছু নয়; বরং এটি সেই দীর্ঘ সমালোচনামূলক আলোচনারই সারসংক্ষেপ, যা বহু বছর ধরে তাঁর লেখনীকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। প্রয়াত সুসান সনটাগ তাঁকে ‘সমসাময়িক হাঙ্গেরীয় অ্যাপোক্যালিপ্সের গুরু’ বলে অভিহিত করেছিলেন- এই উক্তিটি প্রায় কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ক্রাসনাহোরকাইয়ের জগৎ কেবলই ধ্বংসের নয়; এটি ধ্বংসের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা মানবতার এক করুণ সঙ্গীত। আর এই সঙ্গীতই আজ বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ মঞ্চে স্বীকৃতি পেল।
নোবেল ঘোষণার পর বিশ্বজুড়ে লেখক ও সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া ছিল উচ্ছ্বসিত এবং প্রায় স্বস্তির। আইরিশ ঔপন্যাসিক কোলম তোইবিন (ঈড়ষস ঞষ্টরনল্পহ) তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘লাসলোর নোবেল প্রাপ্তি সাহিত্যের প্রতি আমাদের বিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনে। এমন এক সময়ে যখন সাহিত্য ক্রমশ বিনোদনের পণ্যে পরিণত হচ্ছে, তখন তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, ভাষা হতে পারে এক গভীর দার্শনিক অনুসন্ধানের মাধ্যম। তাঁর বাক্যগুলো পড়া এক অভিজ্ঞতা, এক তীর্থযাত্রা। তিনি আমাদের আরাম দেন না, তিনি আমাদের জাগ্রত করেন।’ পোলিশ নোবেল বিজয়ী ওলগা তোকারচুক, যাঁর নিজের লেখাতেও মধ্য ইউরোপের বিষন্নতা এবং অধিবিদ্যাগত অনুসন্ধান এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে, তিনি বলেন, ‘আমরা, যারা লৌহ যবনিকার আড়ালের পৃথিবীতে বড় হয়েছি, তারা ক্রাসনাহোরকাইয়ের জগতের শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতিকে চিনি। তিনি কেবল হাঙ্গেরির কথা বলেন না, তিনি সমগ্র মানবজাতির এক অন্তহীন অপেক্ষার কথা বলেন। তাঁর নোবেল প্রাপ্তি কেবল তাঁর নয়, আমাদের সবার বিজয়।’ এই প্রতিক্রিয়াগুলো নিছকই আনুষ্ঠানিক প্রশংসা নয়; এগুলোর গভীরে লুকিয়ে আছে সেই স্বীকৃতি যে, ক্রাসনাহোরকাই এমন এক সত্যের কথা বলেন, যা ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে সকলের অভিজ্ঞতাকে স্পর্শ করে।
সমালোচকদের মধ্যে সম্ভবত জেমস উডের বিশ্লেষণটি সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বহু বছর ধরেই ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখনীর একজন গভীর অনুরাগী পাঠক। তাঁর মতে, ক্রাসনাহোরকাইয়ের ঈশ্বরহীন জগতে তাঁর দীর্ঘ বাক্যগুলোই হয়ে উঠেছে এক ধরনের প্রার্থনা। এই বাক্যগুলো কোনো সমাপ্তিতে পৌঁছাতে চায় না, কারণ সমাপ্তি মানেই এক ধরনের ঐশ্বরিক রায়। এর পরিবর্তে, তাঁর গদ্য এক অন্তহীন জাগতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে, যেখানে চরিত্ররা কোনো উচ্চতর শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাদের নিয়তিকে বহন করে চলে। উড মনে করেন, ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাহিত্য একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী ধর্মতাত্ত্বিক সাহিত্য- তবে তা ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে নয়, বরং তাঁর অনুপস্থিতির ভয়াবহ ও করুণ সুন্দর রূপটিকে উন্মোচিত করার জন্য। আর হরি কুঞ্জরু, যিনি সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন, তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় কেবল একটি কথাই লিখেছেন: ‘অবশেষে। বিশ্ব অবশেষে শুনতে পেল সেই কণ্ঠস্বর, যা পরিখার ভেতর থেকে কথা বলে।’ এই সংক্ষিপ্ত উক্তিটির মধ্য দিয়ে তিনি যেন সমগ্র পরিস্থিতিটির সারসংক্ষেপ করলেন। ক্রাসনাহোরকাই সেই লেখকের নাম, যিনি সভ্যতার উজ্জ্বল মুখ নয়, বরং তার অন্ধকার, কর্দমাক্ত পরিখার ভেতরকার সত্যকে তুলে ধরেন। এবং আজ সেই সত্যই সম্মানিত হলো।
তাঁর সাহিত্যকর্মের বিশদ পর্যালোচনায় ঢুকলে দেখা যায়, তাঁর জগৎ মূলত কয়েকটি কেন্দ্রীয় থিমকে ঘিরে আবর্তিত হয়: নিষ্ফল প্রতীক্ষা, মিথ্যা মসিহার আগমন, বিশৃঙ্খলা এবং সৌন্দর্যের আকস্মিক উদ্ভাস। তাঁর সধমহঁস ড়ঢ়ঁং বা সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসেবে বিবেচিত ঞযব গবষধহপযড়ষু ড়ভ জবংরংঃধহপব-এ আমরা দেখি একটি ছোট হাঙ্গেরীয় শহর ধীরে ধীরে বিশৃঙ্খলার গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। শহরে একটি রহস্যময় সার্কাস এসেছে, যার প্রধান আকর্ষণ একটি বিশালকায় তিমির শবদেহ। এই তিমি এবং তার সঙ্গে আসা ‘দ্য প্রিন্স’ নামের এক অশুভ চরিত্র শহরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা ও ধ্বংসের প্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলে। এই বিশৃঙ্খলার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে ভালুস্কা (ঠধষঁংশধ) নামের এক নিষ্পাপ, প্রায় স্বর্গীয় চরিত্র। সে মহাবিশ্বের ঐকতানের স্বপ্নে বিভোর থাকে, কিন্তু শহরের ক্রমবর্ধমান হিংসা তাকেও গ্রাস করে। ভালুস্কার করুণ পরিণতি যেন এই ইঙ্গিত দেয় যে, ক্রাসনাহোরকাইয়ের জগতে নিষ্পাপতার কোনো স্থান নেই, অথবা যদি থাকেও, তবে তা ধ্বংসের জন্যই নির্ধারিত। “ঋড়ৎ রহ ঃযব ফবঢ়ঃযং ড়ভ বাবৎু ংড়ষরঃধৎু ঃৎọহম ংড়ঁষ, ঃযবৎব ষরবং ধ ফৎবধস ড়ভ ড়ৎফবৎ, ধ ুবধৎহরহম ভড়ৎ যধৎসড়হু, যিরপয রং ধষষ ঃযব সড়ৎব ঢ়ধরহভঁষ রহ ধ ড়িৎষফ ঃযধঃ যধং ধনধহফড়হবফ ধষষ হড়ঃরড়হং ড়ভ ড়ৎফবৎ,” -উপন্যাসের এই পঙক্তিটি যেন তাঁর সমগ্র দর্শনের প্রতিধ্বনি। বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে শৃঙ্খলার জন্য মানুষের এই অন্তহীন ও বেদনাদায়ক আকুতিই তাঁর সাহিত্যের মূল চালিকাশক্তি।
তাঁর চরিত্রগুলো প্রায়শই হয় স্বপ্নদ্রষ্টা, নয়তো প্রতারক; কখনও তারা শিল্পী, কখনও উন্মাদ। কিন্তু তারা কেউই প্রথাগত অর্থে নায়ক বা খলনায়ক নয়। তারা সবাই ইতিহাসের এক বিশাল, উদ্দেশ্যহীন খেলার অসহায় শিকার। ডধৎ ধহফ ডধৎ উপন্যাসের নায়ক করিন হাঙ্গেরির এক আর্কাইভিস্ট, যে এক রহস্যময় পাণ্ডুলিপি নিয়ে নিউ ইয়র্কে পালিয়ে আসে, এই বিশ্বাসে যে তাকে এই পাণ্ডুলিপিটি ইন্টারনেটে প্রকাশ করে পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। তার এই মিশন একই সাথে মহৎ এবং হাস্যকরভাবে অর্থহীন। করিনের যাত্রাপথ আমাদের দেখায়, জ্ঞান এবং সত্যের সন্ধান কীভাবে একজন মানুষকে একাকিত্ব এবং উন্মাদনার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের কাছে পরিত্রাণ কোনো অলৌকিক ঘটনায় নিহিত নয়; তা হয়তো লুকিয়ে আছে কোনো শিল্পকর্মের দিকে এক পলক তাকানোর মধ্যে, বা গানের কোনো সুর শোনার মাঝে, অথবা কেবল কোনো সহজ সত্যকে সহজভাবে স্বীকার করার মাধ্যমে। এই নির্মম সততার জন্যই তাঁর সাহিত্য একই সাথে এত ভয়ঙ্কর এবং এত সুন্দর।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের প্রাসঙ্গিকতা ঠিক এখানেই। একুশ শতকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যখন রাজনৈতিক মেরুকরণ, ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতা, পরিবেশগত বিপর্যয় এবং অন্তহীন যুদ্ধের এক জটিল গোলকধাঁধায় আটকে পড়েছি, তখন তাঁর সাহিত্য আমাদের আয়নার মতো কাজ করে। তিনি কোনো সহজ উত্তর বা মুক্তির পথ বাতলে দেন না, কারণ তিনি জানেন কোনো সহজ উত্তর নেই। তাঁর লেখা আমাদের সেই অস্বস্তিকর সত্যের মুখোমুখি করে যে, আমরা এক দীর্ঘস্থায়ী সংকটের মধ্যে বাস করছি, এবং কোনো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বা রাজনৈতিক আদর্শ আমাদের রাতারাতি এই সংকট থেকে মুক্তি দেবে না। ইউক্রেনের যুদ্ধ, যা তাঁর সাক্ষাৎকারের মূল প্রেক্ষাপট ছিল, তা তো এই চলমান মহাপ্রলয়ের একটি দৃশ্যমান রূপ মাত্র। এর বাইরেও রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ধীরগতির সন্ত্রাস, তথ্যের মহামারিতে সত্য-মিথ্যার বিভেদ মুছে যাওয়া, এবং সামাজিক মাধ্যমের অলীক জগতে মানুষের ক্রমবর্ধমান একাকিত্ব।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের চরিত্রেরা যেমন এক ত্রাণকর্তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে নিঃশেষ হয়ে যায়, আমরাও যেন তেমনই কোনো জাদুকরী সমাধানের জন্য অপেক্ষা করছি। তাঁর সাহিত্য আমাদের এই নিষ্ফল অপেক্ষা থেকে বিরত থাকতে বলে; এটি আমাদের বলে, বর্তমানকে তার সমস্ত জটিলতা ও কদর্যতা সহ গ্রহণ করতে। এই নির্মম সততার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে এক ধরনের মুক্তি। তাঁর নোবেল প্রাপ্তি তাই কেবল একজন লেখকের সম্মাননা নয়, এটি আমাদের সময়ের প্রতি এক জরুরি ভাষ্য।
তবে তাঁর জগৎ কেবলই অন্ধকার এবং হতাশায় নিমজ্জিত, এই ধারণাটিও একপেশে।
তাঁর সাহিত্যযাত্রার এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হলো ঝবরড়নড় ঞযবৎব ইবষড়ি উপন্যাসটি, যা তাঁর বিশ্ববীক্ষার এক ভিন্ন, প্রায় ধ্যানমগ্ন দিককে উন্মোচিত করে। এই উপন্যাসে তিনি কোনো একক আখ্যান অনুসরণ করেননি; বরং বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময়ে ছড়িয়ে থাকা শিল্প সৃষ্টির মুহূর্তগুলোকে খণ্ড খণ্ড চিত্রে এঁকেছেন। জাপানের কিয়োটোতে এক শিল্পী একটি নো (ঘড়য) নাটকের মুখোশ তৈরি করছেন, পেরুগিয়ার এক গির্জায় শিল্পীরা ফ্রেস্কো পুনর্গঠন করছেন, ভেনিসের বেলিনি স্টুডিওতে এক চিত্রকর সাধকের ছবি আঁকছেনÍএই সমস্ত মুহূর্তগুলো এক অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা। সেই সুতোটি হলো সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের চিরন্তন আর্তি। এই উপন্যাসে ক্রাসনাহোরকাই দেখান যে, বিশৃঙ্খলা এবং ধ্বংসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে শিল্প ও সৌন্দর্য এক ধরনের পবিত্র শৃঙ্খলা তৈরি করে। ‘দ্য ইয়েল রিভিউ’-এর সাক্ষাৎকারে তিনি যেমনটা বলেছিলেন, সৌন্দর্য এক সীমানার ওপারে থাকে, যাকে আমরা কেবল দূর থেকে অবলোকন করতে পারি। এই অবলোকনের মধ্যেই নিহিত আছে এক গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। এটি আমাদের এই নশ্বর, ত্রুটিপূর্ণ জগতের ঊর্ধ্বে এক উচ্চতর সম্ভাবনার কথা মনে করিয়ে দেয়। সুতরাং, ক্রাসনাহোরকাই কেবল মহাপ্রলয়ের বর্ণনাকারী নন, তিনি সেই মহাপ্রলয়ের মধ্যে টিকে থাকা সৌন্দর্যেরও উপাসক। তাঁর নোবেল প্রাপ্তির পেছনে এই দ্বৈততাই হয়তো সবচেয়ে বড় যুক্তি যেখানে তিনি যেমন নির্ভুলভাবে নরকের মানচিত্র আঁকতে পারেন, তেমনই স্বর্গের ক্ষণস্থায়ী আভাসটুকুও চিনতে তাঁর ভুল হয় না।
শেষ পর্যন্ত, লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল প্রাপ্তির পেছনের যুক্তিগুলোকে যদি একত্রিত করা হয়, তবে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত, তাঁর অতুলনীয় এবং বিপ্লবী গদ্যশৈলী, যা ভাষার প্রচলিত ব্যাকরণকে অস্বীকার করে মানব চেতনার জটিল ও অন্তহীন প্রবাহকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মানব অস্তিত্বের অন্ধকারতম দিকগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সৎ সাহস, যা কোনো সহজপাচ্য নৈতিকতা বা সমাধানের আশ্রয় নেয় না। তৃতীয়ত, তাঁর গভীর মানবতাবাদ, যা সবচেয়ে পতিত এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও পবিত্রতার সন্ধান করে এবং তাদের অস্তিত্বের সংগ্রামকে এক মহাকাব্যিক মর্যাদা দান করে। এবং চতুর্থত, তাঁর দর্শনের অসামান্য প্রাসঙ্গিকতা, যা একুশ শতকের এই সংকটময় মুহূর্তে আমাদের ‘চলমান মহাপ্রলয়ের’ স্বরূপ চিনতে সাহায্য করে। সুইডিশ অ্যাকাডেমি কোনো সহজপাঠ্য বা জনপ্রিয় লেখককে বেছে নেয়নি; তারা বেছে নিয়েছে এমন একজনকে, যাঁর লেখা পাঠ করা এক শ্রমসাধ্য কিন্তু অপরিহার্য অভিজ্ঞতা। তারা সেই লেখককে সম্মান জানিয়েছে, যিনি আমাদের এই ভাঙনের কালে দাঁড়িয়ে সাহসের সঙ্গে বলতে পারেন- ভবিষ্যৎ একটি ভ্রম, আশা একটি ফাঁদ, এবং আমাদের একমাত্র সম্বল হলো এই তীব্র, যন্ত্রণাদায়ক, এবং কখনও কখনও অলৌকিকভাবে সুন্দর বর্তমান।
নোবেল পুরস্কার সাহিত্যের জগতে এক ধরনের পূর্ণচ্ছেদ বা সমাপ্তি চিহ্ন। এটি একজন লেখকের জীবনব্যাপী সাধনার সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, লাসলো ক্রাসনাহোরকাই সেই লেখক, যিনি পূর্ণচ্ছেদের অধিকারে বিশ্বাস করেন না। তাঁর কাছে মানব জীবন এবং তার বর্ণনা এক অন্তহীন বাক্য, যা চলতেই থাকে। তাই এই পুরস্কার তাঁর যাত্রার সমাপ্তি নয়, বরং তাঁর সৃষ্ট জগতের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটি উপলক্ষ মাত্র। এই সম্মানের আলোয় আমরা হয়তো নতুন করে তাঁর সেই বৃষ্টিভেজা, কর্দমাক্ত পথগুলোতে হাঁটতে শুরু করব, তাঁর দিশেহারা চরিত্রদের পাশে গিয়ে দাঁড়াব এবং তাদের ব্যর্থ প্রার্থনার নীরব সাক্ষী হব। আর এই যাত্রাপথে আমরা হয়তো আবিষ্কার করব যে, সমস্ত হতাশার গভীরেও এক ধরনের করুণা লুকিয়ে থাকে, আর সেই করুণাই হলো লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাহিত্যের শেষ কথা। তিনি সেই অসীমের যাত্রী, যিনি আমাদের এই সসীম পৃথিবীর অন্তহীন গল্প বলে চলেছেন।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক।



