জামাল উদ্দিন হাসান বান্না’র জীবন ও সংগীত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১১ মার্চ ২০২৩, ৭:১০:২৩ অপরাহ্ন

সিলেটের সংগীত অঙ্গনে একটি উজ্জ্বল নাম-জামাল উদ্দিন হাসান বান্না। কিংবদন্তিতুল্য বললেও অত্যুক্তি হবে না। তাঁর কৃতী ও কীর্তি সংগীত নিয়েই। তিনি আধুনিক গান, স্বদেশি গান, ইসলামি গান, পল্লিগীতি, ছায়াছবির গান, বাউল গানÑসবই গেয়েছেন; কিন্তু আধুনিক ও লোকসংগীতেই মৌলিকতা ও সাফল্য সবচেয়ে বেশি। তাঁর প্রধান পরিচয় একজন কণ্ঠশিল্পী হিসেবেই।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে সিলেট শহরের দরগাহ মহল্লা মুফতি বাড়িতে তাঁর জন্ম। বাবা মুফতি ফখরুদ্দিন আহমদ ছিলেন স্বনামধন্য অ্যাডভোকেট এবং মা বেগম জাহেদা খাতুন। বান্নার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। কিছুদিন সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজে (এমসি কলেজ) অধ্যয়ন করেন। গান-বাজনায় মগ্ন ছিলেন বলে কলেজে অনিয়মিত দেখে বড়োভাই অধ্যাপক বাহাউদ্দিন জাকারিয়া তাঁকে মদনমোহন কলেজে নিয়ে আসেন। তিনি তখন এ কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু পড়াশোনায় এখানেও তাঁর মন বসেনি। বান্না অধ্যয়ন পরিত্যাগ করে গানের জগতে নিমগ্ন হন।
সে সময় ছিল অত্যন্ত বৈরী পরিবেশ। মুসলিম ছেলেমেয়েরা গান-বাজনা করত না। তিনি রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও সংগীতচর্চা করেন। অবশ্য মামা সরেকওম মোহাম্মদ উবায়দুল্লাহ ছিলেন একজন এসরাজ ও বংশিবাদক । মা-বাবা সংগীত খুব একটা পছন্দ করতেন না। এ ক্ষেত্রে বড়োভাই অধ্যাপক বাহাউদ্দিন জাকারিয়া তাঁকে উৎসাহ জোগাতেন। ভাবির বড়োভাই সিএম কয়েস সামি এবং তৎকালীন সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ’র উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা স্মরণযোগ্য।
কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালিম নিয়ে তিনি গান শিখেননি। তিনি প্রথমে ছিলেন স্কুল-কলেজের একজন গায়ক। নিজ চেষ্টায় গান গাওয়া রপ্ত করেন এবং স্কুল-কলেজ জীবনেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। প্রিয় শিক্ষক (কণ্ঠশিল্পী শুভ্রদেবের বাবা) শৈলেশ বাবু ও আবদুল মান্নান তাঁকে সংগীত চর্চায় উৎসাহ দিতেন। তারপর অল্প সময়ের জন্য উস্তাদ আলী আকবর খানের মাধ্যমে তাঁকে সংগীতের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয় ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জামাল উদ্দিন হাসান বান্না বাংলাদেশ বেতার ও ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে টেলিভিশনে গান গাওয়ার সুযোগ লাভ করেন এবং শিল্পীর মর্যাদা পান। সিলেট শহরে মুক্তসংগীত নিকেতন গড়ে তুলে তিনি কিছুদিন প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। টেলিভিশনের আমার ঠিকানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও শিল্পী সৃষ্টির সুযোগ ঘটে। বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে গান পরিবেশন করার সুযোগ পান। মোস্তফা জামান আব্বাসী, সাবিনা ইয়াসমিন, আকরামুল ইসলাম, কিরণ চন্দ্র রায়, চন্দনা মজুমদার, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, দিপ্তী রাজবংশী, ফকির শাহাবুদ্দিন প্রমুখ শিল্পীর সঙ্গে গান গাওয়ার সুযোগ হয় তাঁর।
বেতার, টেলিভিশন চলচ্চিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে গান গেয়ে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কাতার, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, জাপান, কাতার, ইউএই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ইত্যাদি রাষ্ট্র সফর করে তিনি বিদেশিদের কাছে লোকসংগীতের পরিচয় তুলে ধরেন।
বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের গানে রয়েছে তাঁর বিশেষ গায়কি খ্যাতি। তাঁর সঙ্গে ছিল করিমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এছাড়া হাসন রাজা, রাধারমণ দত্ত, শিতালং শাহ, সৈয়দ শাহনুর, আরকুমশাহ, দুর্বিনশাহ, গিয়াস উদ্দিন আহমদ প্রমুখ পদকর্তার সংগীতের প্রতি বান্নার অনুরাগ ও খ্যাতি সুবিদিত। মরমি গানে তিনি আজও অদ্বিতীয়। তাঁর দরদভরা কণ্ঠে মরমি ধারার গানগুলো অতি চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। দুর্বিনশাহর বিখ্যাত গান ‘আমার অন্তরায়, আমার কলিজায়’ তিনিই চলচ্চিত্রে পরিবেশন করেন।
তাঁর গাওয়া অসংখ্য গান খুবই জনপ্রিয়। তিনি প্রায় বারোশো গানে কণ্ঠ দান করেছেন। সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি দেশে-বিদেশে বহু সম্মাননা ও পদক লাভ করেছেন।
জামাল উদ্দিন হাসান বান্না ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত। তাঁর স্ত্রীর নাম দুর্দানা হাসান টুকটুক। হবিগঞ্জের বানিয়াচঙ্গের বিখ্যাত মুসলিম পরিবারে তিনি বিবাহ করেন ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ এবং সাবেক সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান জাহেদ তাঁর চাচাত শ^শুর। বান্না দুইপুত্র সন্তানের জনক। নিয়াজ আহমদ ও এজাজ আহমদ ফারহাজ লেখাপড়া করছেন।
জামাল উদ্দিন হাসান বান্না বিভিন্ন সামাজিক ও সংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আছেন। তিনি বাংলাদেশ লোকসংগীত পরিষদের সিলেট বিভাগের সভাপতি, বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সিলেট বিভাগের সাধারণ সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক ফোরামের সিলেট জেলার প্রেসিডেন্ট।