বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী
যাঁর ছিলো না বিত্তের উত্তাপ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ৭:৫৩:৩৫ অপরাহ্ন
আবদুল হামিদ মানিক :
বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীকে প্রথমবার দেখে আমার পর্যবেক্ষণজাত ধারণা প্রবল ধাক্কা খেয়েছিল। একান্তই সাদামাটা পোশাক। দৃষ্টিতে ঔদ্ধত্য বা বিত্তের উত্তাপ নেই। কণ্ঠে কর্তৃত্বের সুর নেই। বিন¤্র ভঙ্গিতে হেঁটে আসছেন মঞ্চের দিকে। প্রথম দর্শনেই মনে হয়েছিল তিনি ব্যতিক্রমী এক মহিলা। প্লে-ইন লিডিং হাই থিংকিং নীতি ধনী এবং গরীবের জীবনে সমান তাৎপর্য রাখেনা। এদিক থেকেও আমি ওই প্রথম দেখার মুহূর্তে আলোড়িত হয়েছিলাম।
বরাবরই আমরা দেখি, বিত্তবান মানুষের কথাবার্তা আচার আচরণে একটা উত্তাপ ও প্রভাব ফুটে ওঠে। বিশেষ করে গরীব দেশের ধনী মানুষ কেমন যেন একটি দেয়াল নির্মাণ করে সমাজে বিচরণ করেন। কিন্তু রাবেয়া ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। একেবারে মাটির মানুষ ছিলেন।
তিনি এখন নেই। কিন্তু সব ‘নেই’ শাব্দিক অর্থে ‘নেই’ হয় না। যেমন হয়নি সমাজসেবী বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর বেলায়। তিনি ভাগ্যবতী। ফিলানথ্রপিক কার্যক্রমে বিশাল ব্যক্তিত্ব দানবীর ড. রাগীব আলীর ভাবমূর্তির আড়ালে তিনি হারিয়ে যাননি। যাননি, কারণ তিনি নিজেও ছিলেন গুণবতী, জনকল্যাণে আন্তরিক এক মহীয়সী।
বিত্ত সম্পদ সুস্থ জীবনের জন্য আবশ্যক। বিত্তবান হওয়ার চেষ্টা তাই সবাই করে। ধর্মও দারিদ্র থেকে বেঁচে থাকার তাগিদ দেয়। তবু সবাই বিত্তবান হয় না, হতে পারে না। তাই সমাজে সব সময় ধনী গরীব ছিল, আছে। সেই খ্রিস্টপূর্ব সময়েও দেখি, সক্রেটিস-প্লেটোর কথোপকথনে সম্পদ প্রসঙ্গ আলোচিত হচ্ছে। প্লেটোর অমর গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’ এ জ্ঞানীজনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সম্পদের আশীর্বাদ দুটি। এক, সম্পদ ব্যক্তিকে পরমুখাপেক্ষিতা থেকে রক্ষা করে। দুই, সম্পদশালী ব্যক্তি ইচ্ছা করলে অন্যের কল্যাণ সাধন করতে পারে।
সম্পদের প্রথম আশীর্বাদ সাধারণ। দ্বিতীয়টি ঐচ্ছিক। অর্থাৎ ব্যক্তির মর্জি মন মানসিকতার উপর নির্ভরশীল। সমাজসেবায় ব্যয় না করলে কেউ বাধ্য করতে পারে না। আর সে জন্যই ঐচ্ছিক ক্ষেত্রে যারা ব্যয় করেন, বিত্তবানদের মধ্যে তাঁরা আলাদা মানুষ। মানুষ ব্যয় করে বাঁধা নিয়মে ফর্দ অনুযায়ী আর অপব্যয় করে নিজের খেয়াল, ইচ্ছা ও রুচি অনুযায়ী। তাই মানুষটির আসল পরিচয় পাওয়া যায় তার স্বেচ্ছাব্যয়ে। অপব্যয় বলতে খারাপ পথে নয় বরং বুঝানো হয়েছে সেই ব্যয়, যা না করলে কেউ তিরস্কার করবে না। দানশীল ব্যক্তিত্ব রাগীব আলী ও তাঁর সহধর্মিনী রাবেয়া খাতুন চৌধুরীকে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই সুধীজন মূল্যায়ন করেন। সমাজের আশীর্বাদপুষ্ট এই দম্পতি তাঁদের বিত্তের জন্যই নয় বরং কর্মের কল্যাণমুখী মনমানসের জন্যই প্রশংসিত, সম্মানিত হয়েছেন।
ধন-সম্পদ যেকোনো লোকের থাকতে পারে। এর উপর মানুষের প্রকৃত শ্রেণীকরণ যথার্থ নয়। সম্পদ কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে- এর উপর নির্ভর করছে। মানুষের মনুষ্যত্ব, মহত্ত্ব এবং মর্যাদা। রাগীব-রাবেয়া দম্পতির চেয়ে বেশি সম্পদের মালিক বাংলাদেশে আছেন। এক এগার’র পর জিরো থেকে হিরো হওয়া অসংখ্য ধনীর সন্ধান পেয়েছে এদেশের মানুষ। কোনো অবলম্বন নেই, পেশা নেই, অথচ হাজার কোটি টাকা আছে নামে-বেনামে। এদের জীবনের অর্থবিত্তের খুঁটিনাটি বিচিত্র তথ্য জানা গেছে। কিন্তু জনকল্যাণে কানাকড়ি খরচ করেছেন বলে জানা যায়নি।
অর্থনীতির পয়লা সবক হচ্ছে অভাব অসীম-‘ওয়ান্টস আর আনলিমিটেড’। এ তত্ত্বের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেখেছে মানুষ। অবৈধ পন্থায় হাজার কোটি টাকা সঞ্চয়ের পরও আরো সঞ্চয়ের বলগাহীন তাড়নায় কেউ কেউ ছিল উন্মত্ত। এ নেশার তলে তাদের মানসিক বোধ ও নীতিনৈতিকতা সম্পূর্ণ চাপা পড়ে গিয়েছিল। এমনি একটি দেশে রাগীব-রাবেয়া দম্পতিকে সামনে রেখে বলতেই হয়, অর্থ মানুষকে পিশাচ করে তোলে আবার অর্থ মানুষকে মহৎ করে তোলে। বলা যেতে পারে অর্থবিত্ত দিয়েই তাঁরা মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। কিন্তু কালজয়ী দার্শনিক সক্রেটিস বলেন, ‘অর্থ থেকে সদ্গুণ জন্মে না, বরং অর্থ ও অন্যান্য কাম্য বিষয় সদ্গুণ থেকেই জন্ম গ্রহণ করে।
রাবেয়া খাতুন চৌধুরী ছিলেন ওই গুণে গুণবতী আলোকিত মহিলা। বৃটেন প্রবাসী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, স্বাপ্নিক স্বামীর সংসার মনের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে জীবনযাপনেই ব্যস্ত থাকতে পারতেন। কিন্তু চিরাচরিত গৃহবধূর চেয়ে তিনি ছিলেন পৃথক ধাচের মানুষ। তাই স্বাপ্নিক স্বামী যে মিশন নিয়ে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করেন, তাঁর সুযোগ্যা সহচরী হিসেবে তিনি তাতে শরীক হলেন। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, খেলাধূলা, সাংবাদিকতা, সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সমাজকল্যাণের নানা অঙ্গনে রাবেয়া খাতুন নিজেকে জড়িয়ে নিলেন। শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, লেখক, বুদ্ধিজীবী যারা এভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, সবাই তাঁর ব্যবহার, নিষ্ঠা ও কল্যাণমুখী দৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়েছেন।
বিয়ের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন নারী এক দেহে লীন হয়ে যান। তাই একে অন্যকে বুঝতে পারেন সর্বোচ্চ মাত্রায়। এ জন্যই স্বামীর চোখে স্ত্রী এবং স্ত্রীর চোখে স্বামীর মূল্যায়ন অত্যন্ত মূল্যবান। আমাদের মূল্যায়ন বাইরের কিন্তু স্বামী স্ত্রীতে পারিবারিক মূল্যায়ন ভেতর ও বাইরের বলেই তা চূড়ান্ত। ‘আমার জীবন আমার স্মৃতি’ গ্রন্থে (প্রকাশকাল : ১লা সেপ্টেম্বর-২০০৬) ড. রাগীব আলী স্ত্রী সম্পর্কে বলেছেন, ‘মনে ভয় ছিল, একটি অভিজাত পরিবারের মেয়ে হঠাৎ শহর থেকে গ্রামে এসে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারবে কি না। আল্লার রহমতে রাবেয়া নিজগুণে তার শ্বশুর শ্বাশুড়ী দেবর ভাসুর আত্মীয়-স্বজনকে আপন করে নিলেন। মাইজি অনেক খুশি হলেন তাঁর পুত্রবধূর আচার ব্যবহারে। …. বুঝলাম আল্লাহতালা আমাকে এক গুণবতী স্ত্রীরতœ দান করেছেন। আমি কর্মপাগল মানুষ। স্ত্রীকেও পেলাম আমার সকল কাজের সাথী হিসেবে।”
হ্যাঁ, অপর পক্ষ অর্থাৎ স্ত্রীও তাঁর স্বামীর প্রশংসায় ছিলেন আজীবন পঞ্চমুখ। অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ লোকমান আলী লিখেছেন, রাবেয়া খাতুন প্রায়ই বলতেন, ‘সে মানুষটা একটা তুখোড় প্রতিভার অধিকারী। কোনো কিছুতে হাত দিয়েছেন তো শেষ না করে ছাড়ছেন না।’ এই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও বিশ্বাসই সমাজকর্মে এই দম্পতিকে দান করেছে অম্লান সাফল্য।
বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী একজন সফল সৌভাগ্যবতী মহিলা। তিনি এবং তাঁর স্বামী কর্মের স্বীকৃতি কমবেশি পেয়েছেন। কিন্তু এটাই শেষ নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ফিলানথ্রপিক কার্যক্রমের স্বীকৃতি সমকালে খুব কম আসে। রাগীব-রাবেয়া দম্পতি শুধু হাতে হাতে দান খয়রাতেই কর্তব্য শেষ করেন নি। এমন সব প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছেন, এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, যেখান থেকে দাতা নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলেও এর সুফল ও সেবা অব্যাহত থাকবে। এ ধরণের কার্যক্রমের স্বীকৃতি দান এবং অর্থ, মেধা ও শ্রমদানকারীদের মূল্যায়ন সমাজের স্বার্থেই প্রয়োজন। বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীকে এজন্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে আমরা স্মরণ করছি।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সিলেটের ডাক