তিন শিক্ষক পুলিশ হেফাজতে
আখালিয়ায় কোরআন অবমাননার অভিযোগে সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমিত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ আগস্ট ২০২৩, ২:৩৩:৫৬ অপরাহ্ন
ফেইসবুক লাইভে উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ঃ এসএমপি কমিশনার
ফেইসবুকে কিছু দেখলেই উত্তেজিত হবেন না ঃ আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী
স্টাফ রিপোর্টার : সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার ধানুহাটারপাড়ায় মুসল্লীদের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে। অভিযোগ ছিলো, আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপাল ও চেয়ারম্যান নুরুর রহমান (৫০) এবং একই কলেজের শিক্ষক মাহবুব আলম (৪৫) পবিত্র কোরআন মজিদ পুড়িয়ে দিয়েছেন। অবশ্য তাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ওই কোরআন মজিদগুলো ছিলো অনেক দিনের পুরনো ছেড়া ও প্রিন্টিং ত্রুটিযুক্ত। যা পড়লে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ার আশংকা ছিল। অন্যদিকে গত রোববার রাতেই আবেগতাড়িত মুসল্লীদের বিক্ষোভের মুখে দুই শিক্ষককে তাৎক্ষণিক পুলিশ হেফাজতে নিয়ে আসা হয়। এরপর র্যাব ৯ এর একটি টিম অপর একজন শিক্ষককে হেফাজতে নিয়ে আসে। গতকাল সোমবার রাত ১০টা পর্যন্ত নুরুর রহমান এবং মাহবুব আলম পুলিশ হেফাজতে ছিলেন। ইসহাক নামের ওপর শিক্ষক র্যাবের হেফাজতে রয়েছেন বলে জানান কতোয়ালী থানার ওসি।
অন্যদিকে রোববার রাতে মুসল্লীদের বিক্ষোভ ঠেকাতে কঠোর ছিলো আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফাঁকাগুলি, রাবার বুলেটসহ সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় পুলিশ সদস্যরাও আহত হন। এ ঘটনায় এসএমপির পুলিশ কমিশনার, নবনির্বাচিত মেয়র, ইমাম সমিতির নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
জানা যায়, রোববার রাত ১০টার দিকে নুরুর রহমান ও মাহবুব আলম অনেক দিনের পুরনো ছেঁড়া ও প্রিন্টিং ত্রুটিযুক্ত কিছু কোরআন শরিফ পুড়িয়ে ফেলতে শুরু করেন। এ সময় স্থানীয় লোকজন দেখে ফেলায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং এ দুজনকে মারধর শুরু করেন। এ সময় কিছু ফেইসবুক পেইজ থেকে উস্কানি দিলে বাড়তে থাকে বিক্ষুব্ধ মানুষের সংখ্যা। এক পর্যায়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ ওই এলাকায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে আসে এবং জনতার হাত থেকে নুর ও মাহবুবকে উদ্ধার করে। এ সময় উত্তেজিত জনতা পুলিশের দিকে ইট পাটকেল ছুঁড়তে থাকেন। এতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। আহত পুলিশ সদস্যরা বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও শর্টগান ব্যবহার করে। রাতে ওই এলাকায় কোতোয়ালি থানা, জালালাবাদ থানা, সিআরটি ও গোয়েন্দা পুলিশের ৫ শতাধিক সদস্য কাজ করে। এছাড়া পুলিশের পাশাপাশি র্যাব-৯ এর একটি টিমও কাজ করে।
অপরদিকে গতকাল সোমবার রাত ১০টা পর্যন্ত এ ঘটনায় ৩ জন পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন। কতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ আলী মাহমুদ জানান, নূরুর রহমান ও মাহবুব তাদের হেফাজতে রয়েছেন। আর ইসহাক নামের অন্যজন র্যাব তাদের হেফাজতে নিয়ে গেছে। র্যাব-পুলিশ যৌথভাবে বিষয়টি দেখছে বলে জানান তিনি। এ ঘটনায় থানায় একটি মামলাও হয়েছে।
এদিকে, গতকাল সোমবার দুপুরে আখালিয়া এলাকার ধানুহাটারপাড়স্থ আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ পরিদর্শন করেছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. ইলিয়াছ শরীফ বিপিএম-(বার), পিপিএম।
পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পুলিশের কমিশনার মো. ইলিয়াছ শরীফ বলেন, ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে লাইভ করা হয়। লাইভে অনেকেই বিভিন্নভাবে এই বিষয়টি ছড়িয়ে দিয়েছেন। উস্কানীমূলক কথাবার্তা বলে মানুষকে জড়ো করেছেন। তদন্ত করে যাদের গুজব ও উস্কানীমূলক বক্তব্য পাবো তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। যাদেরকে আটক করা হয়েছে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে তারা ছাত্র জীবনে শিবিরের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পরিদর্শন শেষে নবনির্বাচিত সিসিক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সিলেট আধ্যাত্মিক নগরী। হযরত শাহজালাল রহ. ও শাহপরান রহ. স্মৃতি বিজড়িত শান্ত সিলেটকে কিছু লোক অশান্ত করতে এমন হীন প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করে যারা এই গুজবকে ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করেছেন এদেরকেও আইনের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানান।
তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ঘটনার খবর পাওয়ার সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর প্রতিটি টিম আন্তরিকতার সাথে কাজ করেছেন যাতে সিলেটের মানুষের কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয়। ঘটনার শুরু থেকে ঢাকা থেকে পুলিশের আইজিপি খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। আমার সাথেও তার কথা হয়েছে। তাদের তাৎক্ষণিক ভূমিকার কারণে বড় ধরনের বিপদ থেকে প্রিয় নগরী রক্ষা পেয়েছে। এই শান্ত সিলেটকে কারা অশান্ত করতে চায় এবং তাদের উদ্দেশ্যে কী? এ বিষয়ে সবার খোঁজ নিতে হবে।
তিনি নগরবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, কোনো কিছু ঘটলে বা ফেইসবুকে দেখলে সাথে সাথে উত্তেজিত হবেন না। আগে বিষয়টি সত্য-মিথ্যা যাচাই করুন। রোববারের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সঠিক সময় ব্যবস্থা না নিলে আমাদের জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতো পারতো। তিনি স্থানীয় কাউন্সিলর ও সচেতন এলাকাবাসীকেও ধন্যবাদ জানান। এ সময় সিলেট মহানগর পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ, কোতোয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী মাহমুদসহ উধ্বর্তন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ (পিপিএম) জানান, রোববার রাত ১০টার দিকে আখালিয়া এলাকায় লোকজন জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে এবং জনতার হাত থেকে নুরুর রহমান ও মাহবুবকে উদ্ধার করে। এ সময় উত্তেজিত জনতা পুলিশের দিকে ইট পাটকেল ছুঁড়তে থাকেন। এতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয় এসময়। আহত পুলিশ সদস্যরা বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে, ঘটনার পরপর জাতীয় ইমাম সমিতির সিলেট মহানগর সভাপতি মাওলানা হাবীব আহমদ শিহাব ও ইমাম নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে যান। তারা এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে ত্রুটিযুক্ত পবিত্র কোরআনের হেফাজত সম্পর্কিত মাসায়ালাসহ ধর্মীয় নির্দেশনাবলী সম্পর্কে ধারণা দেন। এসময় তারা বলেন, যারা কোরআন পুড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন তারা ইসলামী উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত। তাদের কোরআন পুড়ানোর উদ্দেশ্য যদি কোরআনের হেফাজত হয়ে থাকে তাহলে তাদের বিষয়টি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দরকার, অথবা যদি অসৎ উদ্দেশ্য হয় তবুও তারা আইনের উর্ধেব নয়। মাওলানা হাবীব আহমদ শিহাব বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে উস্কানি দেয়া হয়েছে ভবিষ্যতে আরো সচেতন থাকা প্রয়োজন। না হয় বড় ধরনের দাঙ্গা হাঙ্গামা হতে পারে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কোরআনের হেফাজতকারী হিসেবে কবুল করুন।
এ ব্যাপারে প্রিন্সিপাল নূরুর রহমানের স্ত্রী সৈয়দা মাহফুজা কাওসার জানান, তিনি নিজেও ওই কলেজের প্রভাষক। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিধারী। তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছর ধরে আইডিয়াল কলেজ চলছে। তাঁর স্বামী নুরুর রহমান একজন ইসলামিক স্কলার। যিনি কুষ্টিয়া ইসলামী ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স মাস্টার্স ও এমফিল করেছেন। সৈয়দা মাহফুজা কাওসার জানান, ১৪ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে পবিত্র রমজান মাসে কোরআন শিক্ষা দেয়া হয়। শহরের প্রতিষ্ঠান হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী কোরআন মজিদ রেখে চলে যায়। এভাবে জমতে জমতে বেশ কিছু কোরআন মজিদ নষ্ট হয়ে গেছে, ছিঁড়ে গেছে। এছাড়া প্রিন্টিংত্রুটিযুক্ত কিছু কোরআন মজিদ জমা পড়েছে। যেগুলোর সঠিকভাবে হেফাজত করা জরুরী ছিলো। এর জন্য তার স্বামী ধর্মীয় নির্দেশনার আলোকে সেটা হেফাজত করতে গিয়েছিলেন, অন্য কোন উদ্দেশ্য নয়। সৈয়দা মাহফুজা কাওসার তার স্বামী ও পুলিশ হেফাজতে থাকা শিক্ষকদের প্রতি যাতে অন্যায়ভাবে হয়রানী ও অবিচার না করা হয়, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।