‘চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন’
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ৭:৫৬:১৭ অপরাহ্ন
মিহিরকান্তি চৌধুরী
প্রফেসর মো. আবদুল আজিজ একজন খ্যাতিমান শিক্ষক, খ্যাতিমান লেখক। লেখকসত্ত্বার সাথে বাড়তি এক অবধারিত বিশেষণ তাঁর জন্য প্রযোজ্যÑ নির্ভরযোগ্য লেখক। তথ্য ও তত্ত্বের ঘাটতি রেখে লেখেন না, অন্যের লেখাকেও সায় দেন না। দ্বিভাষিক লেখক। বাংলা ও ইংরেজিতে সমভাবে দক্ষ। প্রফেসর মো. আবদুল আজিজের নতুন বই ‘চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন।’
বইটি স্যারের অপ্রকাশিত বেশ কিছু প্রবন্ধের সংকলন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, স্মরণিকাতে প্রকাশিত বেশ কিছু লেখা সংকলিত হয়েছে। লেখাগুলো বিভিন্ন বিষয়ের ওপর। অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ এবং চিত্তাকর্ষক এক গ্রন্থ ‘চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিয়ে লিখেছেন, লিখেছেন সুন্দরী শ্রীভূমি সিলেট নিয়ে, সিলেটে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগমন নিয়ে, রবীন্দ্রনাথের সাথে আমাদের সম্পর্ক, আমাদের ঐতিহ্যের বাতিঘর মুরারিচাঁদ কলেজ নিয়ে। তাঁর শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব, সমসাময়িক কৃতবিদ্য ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবী, লেখক ও গবেষকদের নিয়েও লিখেছেন। কবিকুলে স্থান পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি দিলওয়ার ও বিস্মৃত কবি প্রজেশকুমার রায়। আরও লিখেছেন বিলাতের রোজনামচা, ফ্রান্সের কথা । প্রগতিশীল রাজনৈতিক বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সিলেট জেলায় ছাত্র ইউনিয়নের জন্মকথা ও সিলেটের নানকার বিদ্রোহের ইতিকথা। সিলেটের কিছু স্থানীয় সামাজিক উৎসব যেমন বিয়ে, জন্মদিন ও অন্নপ্রাশনও বাদ যায়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর অংশগ্রহণ ও ভূমিকার কথা এসেছে। সেখানে রয়েছে কিছু স্মৃতি ও কিছু প্রসঙ্গকথা। নিজের কালকে ধরে রাখতেও তিনি সচেষ্ট। ‘সিলেট: আমাদের কালের কথা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি সেই ধাচে লেখা। ‘মৃত্যুর মুখোমুখি যখন’ শীর্ষক প্রবন্ধে ১৯৭০ সালের শমসেরনগর বিমানবন্দরের বিমান দুর্ঘটনার লোমহর্ষক কাহিনী বিধৃত করেছেন। ‘বাংলাদেশের উৎস সন্ধানে’ শীর্ষক প্রবন্ধে দেশের মৌলিকত্ব সন্ধান করেছেন।
একথা সত্য যে তিনি মূলত: শিক্ষক। সেটাই তাঁর সিগনেচার আইডেনটিটি। রবীন্দ্রনাথ যেভাবে মূলত: কবি। রবীন্দ্রনাথের অন্য পরিচয়গুলো যেমন নাট্যকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা যেভাবে খাটো করে দেখা যাবে না, ঠিক একইভাবে আজিজ স্যারের লেখক সত্ত্বাও গৌণ নয়।
প্রফেসর আবদুল আজিজ একজন সুলেখক। তিনি বেশ কিছু গ্রন্থের প্রণেতা। বাংলা ও ইংরেজি উভয় মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস বিষয়ে লিখেছেন। তাঁর ক্ষুরধার লেখনিতে কত সংকলনে যে তাঁর প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে তার শেষ নেই। তাছাড়া, বক্তা হিসেবে তাঁর নিকট থেকে সবসময়ই নতুন কিছু জানার থাকে। আর তাঁর বক্তব্যের বৈশিষ্ট্য হলো, সেটি সাধারণত দীর্ঘ হয় না। তবে সারকথা যথেষ্ট থাকে। যদি দীর্ঘ হয়ও, তবে প্রাসঙ্গিকভাবেই দীর্ঘ হয় এবং সারকথাও বেশি থাকে। গবেষণাধর্মী লেখাতে গ্রন্থসূচি, তথ্যসূত্র, সূচিপত্র, অনুসন্ধানসূত্র সম্বন্ধে তাঁর যে স্বচ্ছ ধারণা তা দেখে বিস্মিত হতে হয়। বর্তমান প্রজন্মের লেখকদের জন্য কোনও কর্মশালায় স্যারের প্রশিক্ষণমূলক বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা তাঁদের সৃষ্টিশীল কর্মোদ্যমের সুশীল বিকাশ ঘটাতে সহায়ক হতে পারে। স্যারের দুই একটি বইয়ের আলোচনা করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এগুলো বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার সাহিত্য পাতায় স্থান পেয়েছিল।
সুপাঠক হিসেবেও তাঁর একটি বিশেষ পরিচিতি আছে। যেকোনও নতুন বই তাঁকে আকৃষ্ট করে। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে যেকোনও বইপুস্তক আগ্রহের বিবেচনায় প্রথম সারিতে অবশ্যই আছে। রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরী দেবী সম্পর্ক এখনও স্যারের আগ্রহের ব্যাপার। এটি যেকোনও অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য প্রেরণামূলক। জানার ইচ্ছা তাঁর মধ্যে সদাপ্রবল। অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান, উপ-প্রধান, গভর্নিং বডির সভাপতি বা কখনও সদস্য কখনওবা বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে স্কুল বা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দিতে আসা শিক্ষক পদপ্রার্থীকে জিজ্ঞেস করতেন, কী ধরনের বই পড়েন, সর্বশেষ কী পডেছেন, এখন কী পড়ছেন ইত্যাদি।
দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তিনি নিজেকে শুধু একজন বিশিষ্ট শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করেননি বরং একজন স্বনামধন্য লেখক হিসেবেও প্রমাণ করেছেন যাঁর কথা আন্তরিকতা ও সত্যতার সাথে সর্বমহলে গৃহীত হয়।
জাতির সার্বিক মঙ্গলের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি কেবল তাঁর শিক্ষাবান্ধব প্রচেষ্টাতেই নয়, তাঁর সাহিত্য সাধনায়ও স্পষ্ট, যেখানে তিনি তাঁর চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, অন্যদের প্রকাশ ঘটাতে সহায়তা করেছেন।
আজিজ স্যারের লেখার পরিম-ল বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় যা একটি সমাজকে গঠন করে এমন বহুমুখী দিকগুলোর গভীর উপলব্ধি প্রতিফলিত করে। স্থানীয় এবং জাতীয় দৈনিক, সাময়িকী এবং জার্নালে নিয়মিত প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধগুলো পাঠকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে যা গভীরতা এবং অন্তর্দৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠকের হৃদয়ে গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় কত বিচিত্র বিষয়ে তাঁর অনুসন্ধান করার ক্ষমতা রয়েছে। তাঁর লেখা তারই এক নিরেট প্রমাণ। স্যারের এই গ্রন্থপাঠে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে, অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয় সম্বন্ধে জানতে পারি। গ্রন্থটি আমাদের দৃষ্টি ও অভিজ্ঞতাকে ঝালাই করে দেয়।
আজিজ স্যার আমাদের সমাজের দায়িত্বশীল শিক্ষাবিদ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে নন্দিত এক অবস্থান থেকে সমাজকে নানা মাত্রার অভিভাবকত্ব দিয়ে আসছেন। প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ভাবনায় উদ্বুদ্ধ এ ব্যক্তিত্বকে বয়সের ভারও তাঁর আদর্শ থেকে নড়াতে পারেনি। লালিত আদর্শের প্রতি অব্যাহত দায়বোধ ধারণ ও প্রদর্শন আমাদের সমাজের জন্য ইতিবাচক একটি বিষয়। এরকম শিক্ষকের ক্লাসরুম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চার দেয়াল ভেদ করে তার নিজের গতিতে বিস্তৃতি লাভ করে।
আজিজ স্যার মহান ভাষা আন্দোলনের একজন বীর সৈনিক। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে স্যার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর এ সম্পৃক্ততা অব্যাহত ইতিবাচকতায় ভাস্বর। আমাদের সমাজের জন্য তা অনন্য সম্পদ হয়ে আছে। কিন্তু তিনি প্রচারবিমূখ হওয়ার দরুণ যে সমাজের অনেক কিছুই জানার ছিল বিশেষ করে আগামী প্রজন্মের জন্য, সেটা হচ্ছে না। তাঁর প্রতি আমাদের বিনীত অনুরোধ থাকবে, ভাষাআন্দোলনে তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি প্রকাশনা করার। প্রয়োজনবোধে অনুলিখনের মতো মাধ্যমকে কাজে লাগিয়েও যদি এধরণের একটি উদ্যোগকে তিনি সায় দেন, তাহলে সমাজ যারপর নাই উপকৃত হবে।
গ্রন্থটির কথায় ফিরে আসি। নামকরণ সুন্দর ও সার্থক হয়েছে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি।