ফররুখ আহমদ : অন্য রঙের চাঁদ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১:৩৩:২৬ অপরাহ্ন
সরওয়ার ফারুকী :
বাংলা-সাহিত্যাকাশে বর্ণিল এক নাম ফররুখ আহমদ। কারও মতো নন, কেউ নয় তার মতো—আপন আলোয় বিকিরিত তিনি। ‘হালকা রেখায় আকাশ চিরে’ ‘আলোকের স্তর’ ভেদ করে তিনি গেছেন অন্তহীনে। ‘রৌদ্র, শিশিরে, নোনা দরিয়ার নীর’ সাঁতরিয়ে যে-রঙ ধারণ করেছেন—তা কেবলই তাঁর। ফররুখ আহমদ অন্যের ফ্রেমে আপনাকে বাঁধেন নি, অন্যের আল্পনায় জগৎ আঁকেন নি। স্ব-উচ্চারণে, স্ব-ভঙিমায় নিজেরে করেছেন উদ্ভাসিত, কাব্য-অক্ষে তিনি একা— আপন বর্ণে বর্ণিল।
আধুনিক বাংলা-কাব্যে জীবনানন্দ যে-ঢং প্রয়োগ করেছিলেন একেবারেই আলাদা আঁকে, নিজের মতো করে, পরবর্তীতে ফররুখই ছিলেন ভিন্ন নিরীক্ষনের সার্থক আমিন। প্যাঁচা, কাক, বিড়াল, কুকুরের জীবনানন্দীয় প্রয়োগের বিপরীতে ফররুখ সী-মোরগের চাহনিতে এঁকেছেন ক্যানভাস, সফেদ সিনায় তুলেছেন ‘মৌসুমী ঝড়’। ‘সবুজ ঘাসের শিয়রে বসে’ শুনেছেন তিনি ‘নোনা দরিয়ার ডাক’। নার্গিস, ইয়াকুত, মারজান, মর্মরে এঁকেছেন ‘ব্যথিত দিলের তুফান’।
রবীন্দ্র-তটে যখন সাহিত্যের নোঙর, জিরোচ্ছে খানিক, তখনই নজরুল ‘বিদ্রোহী’ নিয়ে ধাক্কা দেন মোহাচ্ছন্ন বাংলাকে, কাব্যে সুনামির মতো গতি, শক্তি নিয়ে তিনি আবির্ভূত হন। অব্যবহৃত শব্দের ক্যারেশমাটিক ব্যবহার আর, বিদেশের শব্দ-তরঙ্গে বাংলা সাহিত্যর শরীর নাচিয়ে তুলেন। মরু-ইরানের অপ্সরী এসে বেণি খুললো তার হাতে। তুর্কি, ফার্সি, আরবী শব্দের ঝঙ্কারে অনন্য এক উন্মাদনা তৈরি করলেন তিনি।
হুমায়ুন আজাদের ভাষায় ‘বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ পেরিয়ে উনিশ শতকের সুচনায় আধুনিক যুগ’ এবং একইসাথে সাহিত্যের যে প্লাবন শুরু হয়, তার নেতৃত্বে আসেন রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার হয়ে রবীন্দ্রনাথ। এ সময় বাংলাসাহিত্য বিশ্বময় ছড়িয়ে যাওয়ার জন্যে হন্যে ব্যাকুল, নব-যৌবনে তুমুল নৃত্যের বেলা, কন্ঠে অফুরান সুর, দেহে তার নানা রঙের ডানা। বাংলা সাহিত্যের পাখিগুলো এরপর আর থামে নি, বহুমাত্রিক সুরে ডাকছে অবিরাম ।
হঠাৎ জীবনানন্দ! ছন্দোমুক্তির বৈপ্লবিক বারতা নিয়ে তিনি নাজিল হন বাংলায়। যে কাব্য-শরীরে বাঙালি পাঠকসমাজ ছিল সন্তুষ্ট, জীবনানন্দ দিলেন তা ভেঙে! ভাঙন কেউ মানে না। তাকেও মানা হলো না। ককিয়ে ওঠলেন অনেকেই, ছাপতে চাইলেন না তার কবিতা। ‘কবি-গ-ার’, ‘ভাওয়ালের কবি’ বলে ব্যঙ্গ করলেন সজনীকান্ত। কিন্তু সাহিত্যাকাশ জীবনানন্দকে স্থান দিলো ‘হাতির দাঁতের গড়া মূর্তির মতন।
‘মহাবিশ্ব একদিন অতিস্্রার মতো হয়ে গেলে/মূখে যা বলোনি, নারী, মনে যা ভেবেছো তার প্রতি’ ছুঁড়ে দিলেন তিনি ‘শিশিরের শব্দের মতন’ এক আচানক শব্দতরঙ্গ। হাজার বছর ধরে হেটে আসা পথ বেয়ে দু’দ- শ্রান্তি নিলেন বনলতা সেন-এ।
আধুনিক কাব্যে জীবনানন্দ যদিও জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে, তবুও তিনি একা নন। এখানেই ফররুখ আলাদা, একক। ফররুখীয় কাব্য-শৈলীর কোনো পূর্বসূরী নেই, নেই সার্থক কোনো উত্তরসূরীও। তার কাব্যভাষা যাত্রাকালেই পাঠক-সমাজকে আকর্ষণ করে। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের সপ্তম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে ‘নবনূর’ সম্পাদক সৈয়দ এমদাদ আলী বলেন, “আমাদের নবীন কবিদের মধ্যে ফররুখ আহমদ পথের সন্ধান পাইয়াছেন বলিয়া মনে হয়। তাহার ‘নিশানবাহী’ এবং ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতা ভবিষ্যতের দিক দিয়ে শুভসূচক।” তাই, ফররুখের পথের সন্ধান ‘বাৎলে দেয়া’ নয় বরং একান্ত।
পরম্পরাহীন নবকতনে ফররুখ সকলের থেকেই আলাদা। ‘সুখ-তপ্ত গৃহকোণ ছেড়ে’ ‘দরিয়ার হাম্মামে’ ‘দৌলত, ইজ্জত, খ্যাতি অনায়াসে মাড়িয়ে’ তিনি ‘আকাশ-নাবিক’। ‘হালকা রেখায় আকাশ চিরে’ ‘আলোকের স্তর’ ভেদ করে, ‘রৌদ্র্র, শিশির, নোনা দরিয়ার নীর’ ভেঙে বাংলা-কাব্যে মহাজাগতিক দৃশ্যের সফল এবং সার্থক প্রয়োগকারী। দূর আকাশের তারায় ঘুরে, মুক্ত বিহঙ্গের ডানায় জাফরান, মেহদী মিশিয়ে আকাশ-আঙিনায় অদম্য ফররুখ একা হাঁটলেন।
ফররুখ কাব্যের সুন্দর সারাংশ এঁকেছেন মুজিবর রহমান খাঁ, ‘ফররুখ আহমদের আসল পরিচয় হলো, তিনি একজন শিল্পী কবি। রং ও রূপের বর্ণ এবং তার সাথে গন্ধের আলো-ছায়া এবং মোহের আবিষ্টতা নিয়ে যে-সব খেলার চাতুরি দেখান, তারাই শিল্পী-কবি, তাদের কবিতা চিত্রধর্মী এবং তারা আরো কিছু। ফররুখ আহমদের কবিতা পড়তে পড়তে পাঠক-মন অলক্ষ্যে ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক ও তার পরবর্তী প্রি-র্যাকলাইট কবিদের রাজ্যে চলে যায়। …উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও শব্দরীতি নির্মাণেও ফররুখ আহমদ নতুনত্বের সংযোজন করেছেন।’
ফররুখ চির মুসাফির। সফরের প্রেমে দূরন্ত তার মন, তার প্রগাঢ় উচ্চারণ: ‘সফরের মায়া টানছে আমাকে দূর হতে আরো দূরে’। রঙিন মখমল দিনের আয়েশি গতর ঝেড়ে নতুন সফরের আহবান করেছেন তিনি। সফর-চিত্রে ভৌগলিক সীমা ভেঙেছেন, ভাষার বাঁধ ডিঙিয়েছেন, বিদেশের ভাষা এনে পুঁতেছেন বাংলায়। জগতের সীমা ছিঁড়ে মহাজাগতিক চিত্রকল্প তুলে এনেছেন আমাদের ভাষায়, সাহিত্যে। মহাজাগতিক চিত্রকল্প নির্মাণে এ কবি একা হলেও সার্থক-একক।
আপন শৈলী নির্মাণে, দৃশ্যকাব্যের অদ্ভুত বয়ানে, বিস্ময়কর চিত্রকল্প অঙ্কনে, শব্দতরঙ্গের আচমকা উচ্চারণে তিনি একা। কাব্যাকাশে তার কোনো পূর্বসূরী নেই, নেই কোনো সার্থক উত্তরসূরীও; কাব্য-অক্ষে ফররুখ একা, এক ‘অন্য রঙের চাঁদ’।