সুনামগঞ্জে ধানের ন্যায্য দাম প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত কৃষকরা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ মে ২০২৪, ১০:২৪:৪০ অপরাহ্ন
শহীদনূর আহমেদ, সুনামগঞ্জ থেকে : হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলায় এবার বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। ভালো ফলনে গোলায় স্বস্তি আসায় খুশি কৃষকরা। তবে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ছোট চাষীদের ধান কিনে নিচ্ছে স্থানীয় সুদখোর ও মজুদদাররা। অন্যদিকে, অভিযোগ উঠেছে অন্যান্য বছর স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে গণশুনানী করে কৃষিকার্ড সংগ্রহ করা হলেও এবছর মাঠ পর্যায়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের সঙ্গে আঁতাত করে কৃষিকার্ড সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ সাধারণ কৃষকরা।
সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার এবার সুনামগঞ্জের হাওরে ১ হাজার ২৮০ টাকা মণ দরে ২৯ হাজার ৮১১ মে.টন বোরো ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সিদ্ধ চাল ৪৫ টাকা কেজি দরে ৯ হাজার ৬৮৪ মে.টন ও আতপ চাল ৪৪ টাকা কেজি দরে ৯ হাজার ৯৫৪ মে.টন সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। আগামী আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রহ অভিযান চলবে। এবার লটারির মাধ্যমে ৭টি উপজেলায় এবং ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ৫টি উপজেলায় কৃষকরা গুদামে ধান দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে অথবা গ্রামে গ্রামে গিয়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা আগ্রহী কৃষকদের কৃষিকার্ড সংগ্রহ করার কথা। কিন্তু তারা এটা না করে কম দামে ধান কিনে বেশি দামে বিক্রি করার জন্য মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের সঙ্গে আতাঁত করে কৃষিকার্ড সংগ্রহ করে তালিকার জন্য প্রস্তুত করেছেন। এতে প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে অসচেতন কৃষকদের কার্ড সংগ্রহ করে মধ্যস্বত্বভোগীরা গুদামে ধান দিতে তালিকাভূক্ত হচ্ছে এমন অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিন গত মঙ্গলবার শাল্লা উপজেলার সাতপাড়া বাজার ও কার্তিকপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায় স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাত দুই ব্যক্তির লোকজন বিশাল নৌকায় বস্তাভর্তি ধান তুলছেন। স্থানীয় কৃষকরা জানালেন, তারা প্রতি বছর চৈত্র মাসে কৃষকের পকেট শূন্য থাকার সুযোগ নিয়ে ৭-৮শ’ টাকা মণ দরে ধান কিনে নেয়। এখন সেই ধান নৌকায় ভরে নিয়ে যাচ্ছে।
কার্তিকপুর গ্রামের কৃষক উমর ফারুক বলেন, আমাদের এলাকায় এসে চৈত্র মাসেই সুদখোররা অল্প দামে ধান কিনে নিয়ে যায়। কৃষকদের হাত শূন্য থাকায় এই সময় কৃষি শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ, কৃষি সরঞ্জাম কেনা, মাড়াই ও ধান কাটার যন্ত্রের টাকা পরিশোধ করা, কাঁচি, কুলা, ট্রলির ভাড়া পরিবহনের জন্য সুদখোরদের কাছে অল্পমূল্যে ধান বিক্রি করে দেন। এতে কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছে। দাদন ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে। প্রকাশ্যে এই অনিয়ম চললেও প্রশাসনও উদাসীন। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারাও তাদের দায়িত্ব পালন করেন না।
শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক নৃপেশ দাস বলেন, আমরা সরকারকে সবসময়ই ধান দিতে চাই। কিন্তু কৃষি অফিসাররা আমাদের কাছ থেকে কার্ড সংগ্রহ করেনা। আমাদের ওয়ার্ডে কে দায়িত্ব পালন করেন, তাও জানিনা। আমাদের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। গরিব কৃষকরা মহাজনদের কাছে ধান অনেক আগেই অল্পদামে বিক্রি করে দিয়েছেন। তাদের খোরাকি ছাড়া অবশিষ্ট ধান হাতে নেই।
শাল্লা উপজেলার বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ^জিৎ চৌধুরী নান্টু বলেন, প্রতিটি গ্রামে ছোট বড়ো মজুতদাররা চৈত্র মাসেই অল্পদামে আগাম ধান কিনে নেয়। তারা সরকারের তালিকাভুক্ত না হওয়ায় দিনদিন বেপরোয়া হচ্ছে। তাছাড়া, অন্যান্য বছর কৃষি অফিস আমাদের সহযোগিতা নেয় কৃষকের তালিকা সংগ্রহের জন্য। কিন্তু এবার তারা কেউ যোগাযোগ করেনি। কৃষকরাও আমাদেরকে বলেছেন কেউ তাদের কাছে যায়নি।
এই ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জবা রানী দাস বলেন, আমার এলাকার সবার কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই ফেইসবুকে কৃষকদের তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছি।
শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আলা উদ্দিন বলেন, তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে। কোনও মধ্যস্বত্ব¦ভোগীদের সঙ্গে কেউ আঁতাত করে কৃষকদের বঞ্চিত করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কৃষকরা যাতে ফড়িয়ামুক্ত হয়ে সহজে সরকারি গুদামে ধান দিতে পারে সেই নির্দেশনা সংশ্লিষ্টদের দেয়া আছে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মঈনুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, আমরা অভিযোগ পাচ্ছি বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে সুদখোর ও ফড়িয়ারা কম দামে কৃষকের ধান কিনে মজুদ করছে। যারা ধান চালের ব্যবসা করবে তাদেরকে লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসতে আমরা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবো। তবে গুদামে কোনও কৃষক ধান দিতে এসে হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব।