পরিবারেও অবহেলিত বিশেষ শিশুরা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ৪:০৮:৪২ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম:
বিশেষচাহিদা সম্পন্ন শিশুদের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে অনুপম প্রতিভা। একটু সচেতনতা, একটু মনোযোগ দিলে সেই শিশুরাও স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন যাপন করতে পারতো। কিন্তু, তারা তাদের পরিবারেও বৈষম্য, অবহেলার শিকার হচ্ছে।
অনেক অভিভাবক সন্তানদের কখনো ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে চান না। সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে না। এক ধরণের দ্বিধা বা লজ্জার ভয়ে তারা সন্তানদের প্রতি এমন আচরণ করেন। ফলে সেইসব পরিবারের সন্তানরা আপন ঘরেও আপন হতে পারছে না। অনেকটা একা একাই বড় হচ্ছে। এটি সচেতনতার অভাবে হচ্ছে বলে মনে করছেন সচেতন অভিভাবকরা। আর বিশেষ শিশুদের সেই সচেতন অভিভাবকরা এবার বিশেষ একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা এক প্লাটফর্মে এসেছেন। এই অভিভাবকদের পরিবারে, নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কেউ না কেউ রয়েছেন বিশেষ শিশুর বৈশিষ্ট্য নিয়ে।
‘গার্ডিয়ান এসোসিয়েশন অব স্পেশাল চাইল্ড’ নামে সেই সংগঠনে বর্তমানে অন্তত পঞ্চাশজন সদস্য রয়েছেন। সংগঠন দাঁড় করানোর পর বিশেষ শিশুদের নিয়ে একটি কর্মশালা এবং বনভোজনও হয়ে গেছে।
প্রতিবন্ধী শিশুদের বিশেষ করে অটিজম শিশুদের মানসিক বিকাশে সঠিক পরিচর্যা এবং অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে আয়োজিত কর্মশালায় ইতিবাচক সাড়াও মিলেছে।
সিলেট শহরের মধ্যে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সঠিক সংখ্যা কারো জানা নেই। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা সংস্থার কাছে। যাদের পরিবারে এমন সন্তান রয়েছে, তাদের কেউ কেউ তাদের সন্তানকে কুমারপাড়াস্থ সরকারি সিলেট আর্ট এন্ড অটিজম স্কুলে দিয়েছেন। বর্তমানে সেই বিদ্যালয়ে ৭৫ জন বিশেষ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইসমাইল গণি হিমন বলেন, ২০১২ সালে ৬ জন নিয়ে বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ৭৫ জন বিশেষ স্টুডেন্ট রয়েছেন। আমাদের ধারণক্ষমতা কম থাকায় প্রতিবছরই ওয়েটিংলিস্টে রাখতে হয়। এবারও ৩০ থেকে ৪০ জন শিশু রয়েছে অপেক্ষমান তালিকায়।
সেই বিদ্যালয়ে সন্তানদের নিয়ে আসেন অভিভাবকরা। নিয়মিত যাওয়া আসায় পরিচয় হয়, সখ্যতা বাড়ে অভিভাবকদের মধ্যে। বিদ্যালয়ের পাঠদানের বাইরে নিজেদের সন্তানদের জীবন সহজ করতে, সবশিশুর মধ্যে উদ্দীপনা আরো কিভাবে বাড়ানো যায়-সেরকম পুঞ্জিভ‚ত অভিপ্রায় থেকে সবাই সংগঠন করার সিদ্ধান্ত একমত হন। বলছিলাম ২০২৩ সালের কথা। সাত থেকে আটজন দিয়ে সংগঠনের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে সেখানে ৫০ সদস্য রয়েছেন।
সংগঠনের কয়েকজনের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, সংগঠনে চিকিৎসক, শিক্ষক, সরকার-িবেসরকারি চাকরীজীবী রয়েছেন। প্রবাসেও বসবাস করছেন বিশেষ অনেক শিশুর অভিভাবক। অনেক মা সন্তানদের কথা বিবেচনা করে অনেক ভালো চাকরিও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক অভিভাবক সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে ডিপ্রেশনে(হতাশায়) ভুগছেন।
অন্যদিকে ব্যতিক্রমও আছে। এমনও অনেক অভিভাবক রয়েছেন, যারা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হওয়ায় আপন সন্তানকে লুকিয়ে রাখেন, ঘরের বাইরে পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করেন। কারো সাথে না মিশার কারণে সেই শিশুরা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
একজন সাইকিয়াস্ট্রি মোছা. মাছুমা খানম। তিনি ওই সংগঠনের অর্থ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করছেন। আলাপকালে তিনি বলেন, ‘অনেক অভিভাবক আমরা পেয়েছি, যারা তাদের সন্তানকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসেন না, কারো সাথে মিশতে দেন না। কাউকে পরিচয় করিয়ে দিতে তারা লজ্জ্বাবোধও করেন। আমরা সেরকম কয়েকজন অভিভাবকের বাসায় গেছি, বুঝিয়েছি। অনেকে ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের হয়ে এসেছেন। আমাদের সাথে মিশেছেন। আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন আব্দুল আলিম ভূইয়া। কথা হলে তিনি বলেন, ‘এরা তো আল্লাহর দান। অবহেলা করা, লুকিয়ে রাখা কোনোভাবেই কল্যাণ বয়ে আনবে না। এতে শিশু আরো অসুস্থ হবে, অমঙ্গল হবে।’
সিলেট আর্ট এন্ড অটিস্টিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইসমাইল গণি হিমন বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে যাদের ভর্তি করানো হচ্ছে, তাদের অধিকাংশের বয়স ৮ থেকে ৯ বছর। অথচ ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে ভর্তি করা হলে, সেই শিশুদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসতো। এই সময়ে কথা বলা, তাদের নিজস্ব বন্ধু এমনকি সামাজিকতাও গড়ে উঠতো। অথচ সেটি হয় না অনেকগুলো কারণে। তারমধ্যে একটি হচ্ছে অসচেতনতা। তবে ‘গার্ডিয়ান এসোসিয়েশন অব স্পেশাল চাইল্ড’ অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কাজটি করছে। এ ধরণের সংগঠন থাকলে শিশুদের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। সবার মধ্যে সামাজিকতা সৃষ্টি হয়।’
এই সংগঠনের উপদেষ্টা, শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. শ্যামজয় দাশ। আলাপকালে তিনি বলেন, বিশেষ শিশুর বিকাশে একটি স্কুলই যথেষ্ট নয়। সবার আগে দরকার নিবিড় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ। এর জন্য দরকার অভিভাবকদের একান্ত যতœ। অভিভাবক সচেতন হলে তারা সহজে সুন্দর সমাজ ফিরে পায়।’ তিনি বলেন, ‘এই সংগঠনের মাধ্যমে পারস্পরিক জানাজানি হবে। সেই জানাজানির মাধ্যমে শিশুর জ্ঞান, দক্ষতা গঠনের ক্ষেত্র তৈরী হবে। এরজন্য তাদের প্রতি অবহেলা নয়, দরকার ভালোবাসার।’