বিএনপি নেতা শাহপরানের পদ স্থগিত
জাফলং-সাদাপাথরে ১৫০ কোটি টাকার পাথর লুট
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ৮:৫৬:০৮ অপরাহ্ন

কাউসার চৌধুরী : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির শিথিলতার সুযোগে সিলেটের জাফলং ও ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর থেকে ১৫০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। এর মধ্যে শুধু জাফলং থেকেই ১২০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে বলে খোদ গোয়াইনঘাটের ইউএনও তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন। আর কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আবিদা সুলতানা জানান, সাদাপাথর থেকে লুট হয়েছে ২০ কোটি টাকার পাথর। সরকারি পরিসংখ্যানে দেড়শো কোটি টাকার পাথর লুটের চিত্র উঠে এলে বাস্তবে আরো বেশি টাকার অর্থ লুট হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
প্রকাশ্যে দিনে দুপুরে পাথর লুট করা হলেও ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহসও পাননি। বাল-পাথর লুটের ঘটনায় গোয়াইনঘাট থানায় ৩টি ও কোম্পানীগঞ্জ থানায় ১টি মামলা দায়ের করা হলেও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গণমাধ্যমে খবর পাথর লুটের ঘটনায় বিএনপির নেতাকর্মীরা সম্পৃক্ত। এ ঘটনায় সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরানের পদ স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় বিএনপি।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার সিলেটের ডাককে বলেন, আমরা কেবল ইসিএভুক্ত (ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া) এলাকার পাথর লুটের ঘটনা তদন্ত করেছি। তদন্তে বহু আলামত পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে সকল তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলা দায়ের করা হবে। শুধু জাফলং ইসিএভুক্ত এলাকার পাথর লুটের ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে মামলা দায়ের করা হবে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ জাফলং ও সাদাপাথরের বালু-পাথর লুট হওয়ার বিষয়টি সিলেটের ডাককে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, প্রতিটি ঘটনায় এ বিষয়ে জিডি করা হয়েছে, কোনো কোনো ঘটনায় মামলাও করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করছে। তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর যাতে কেউ পাথর লুট করতে না পারে; এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেট বিভাগের সমন্বয়কারী এ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার বলেন, ২০২০ সালের ৮ জুন সরকারের খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো সিলেটের সকল কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। জাফলং হচ্ছে ইসিএভুক্ত এলাকা। সেখান থেকে সরকারের আইনের প্রতি তোয়াক্কা না করেই পাথর লুট করে নেয়া হয়েছে। কেবল লুট করেই ক্ষান্ত হয়নি; এখন তো পুরোদমে পাথর উত্তোলন শুরু হয়ে গেছে। কারা এর সাথে জড়িত তা জনসমক্ষে আসছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। সরকারের আইনের বিরুদ্ধে উল্টো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ করা হয়, সমাবেশ করা হয়-যা সরাসরি আইন লঙ্ঘনের শামিল।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই স্থানীয় লোকজন জাফলং এলাকায় দফায় দফায় বিজয় মিছিল করেন। এর মধ্যে জাফলং ও তামাবিল এলাকায় স্থানীয় বিএনপির আয়োজনে ৫ আগস্ট সন্ধ্যা পর্যন্ত মিছিল করা হয়। এরপর রাতের আঁধারে জাফলংয়ে শুরু হয় পাথর লুট। ওই রাতে এবং পরের দিন দিনের আলোতে প্রকাশ্যে বিনাবাধায় চলে পাথর লুটপাট। ওই সময় প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার পাথর লুট করে নেয়া হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।
জাফলং এর এত বিপুল পরিমাণ পাথর লুটের ঘটনায় সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরান, বিলুপ্ত হওয়া গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের (ইতোপূর্বে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা) শাহআলম স্বপন, স্থানীয় পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স ও রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ মেম্বারের নাম আলোচনায় এসেছে। পাথর লুটের সাথে সম্পৃক্ততার দায়ে সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরানের দলীয় পদ স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর জাফলংকে পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণার গেজেট প্রকাশ হয়। ২০১২ সালে করা বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই গেজেট প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকে কয়েকটি ধাপে জাফলং থেকে বালু ও পাথর কোয়ারির ইজারা কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছিল। এর মধ্যে বছর বছর পাথর সম্পদ মজুতের বিষয়টি পরিমাপের মধ্যে রাখতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে সংরক্ষিত এলাকায় পাথরের পর্যবেক্ষণ চলে। সর্বশেষ গত ২৬ জুলাই পরিমাপ অনুযায়ী জাফলংয়ে পাথর মজুত ছিল ৩ কোটি ৭৪ লাখ ঘনফুট। ৫ আগস্ট সেখানে ব্যাপক লুটপাট করা হয়। লুটে নেয়া হয়েছে প্রায় ১ কোটি ঘনফুট পাথর। যার বর্তমান বাজার মূল্য শত কোটি টাকারও বেশি। পাথরের সাথে বালুও লুট করা হয়।
বালু-পাথর লুটের ঘটনায় গোয়াইনঘাট থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে ৩ টি মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নম্বর ০৪/১৯৭ তারিখ- ০৪/০৯/২০২৪ , মামলা নম্বর ১০ তারিখ-০৬/১০/২০২৪/মামলা নম্বর-১৭ তারিখ-০৯/১০/২০২৪।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ মেম্বার পাথর লুটের সাথে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘পাথর লুটের সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কেউ বলে থাকলে এটা মিথ্যা।’
বিলুপ্ত হওয়া গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন বলেন, ৫ আগস্ট উপজেলা প্রশাসন রক্ষায় আমি সেখানে সার্বক্ষণিক ছিলাম। লোকজন উচ্ছৃঙ্খলতা করছে শুনে জাফলং গিয়ে তাদেরকে নিয়ে সভা করেছি এবং লোকজনকে সাথে নিয়ে পাথর লুট বন্ধ করি। এরপরেও আমার নাম আসাটা দুঃখজনক বলে মন্তব্য তার।
পদ স্থগিত হওয়া জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরান বলেন, ‘জাফলং পাথর কোয়ারির দিকে আমি যাইনি। ৫ আগস্টের পর পাথর ব্যাবসায়ীরা একদিন মিটিং করেছিলেন আমাকে ওই মিটিং এ দাওয়াত করায় গিয়েছিলাম আর কিছু নয়।’ তিনি দাবি করেন, যদি দোষী হন; তার ফাঁসি হোক – মাথা পেতে নেব। তার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে।
গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমেদ জানান, জাফলং এ বালু পাথর চুরির ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ৩টি মামলা দায়ের করেছে। সবক’টি মামলার তদন্ত চলছে। যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, জাফলং ইসিএভুক্ত হওয়ায় এর বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তর দেখছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি জিডি করা হয়েছে। মামলা করবে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশের লোকজন সরেজমিনে এসে তদন্ত করে বিভিন্ন আলামত সংরক্ষণ করে নিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, আনুমানিক ১২০ কোটি টাকার পাথর লুট করে নেয়া হয়েছে।
সাদাপাথরে ৫০ কোটি টাকার পাথর লুট
সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনই সাদাপাথর পর্যটন স্পট থেকে পাথর লুট শুরু হয়। রোকন উদ্দিন, আব্দুল মতিন মেম্বার, জাবের আহমদসহ স্থানীয় একটি শক্তিশালী গ্রুপ পাথর লুটের নেতৃত্ব দেয়। পুরো এক সপ্তাহ জুড়ে চলে পাথর লুট।
প্রথমে সাদাপাথর থেকে বড় বড় স্টিল নৌকা দিয়ে পাথর লোড করে সরাসরি ছাতকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে ছোট ছোট কাঠের নৌকা দিয়ে সাদাপাথর ও বাংকারের পাথর লুট করে ভোলাগঞ্জ ও কালিবাড়ী এবং কলাবাড়ী এলাকায় নিয়ে আসা হয়। পরে সেখান থেকে গাড়িতে করে স্থানীয় বিভিন্ন ক্রাশার মিলে ও সিলেটের ধোপাগুলে বিক্রি করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সাদাপাথর ও রোপওয়ে সংরক্ষিত বাংকার এলাকা থেকে ৫ আগস্টের পর প্রায় ৫০ লক্ষ ঘনফুট পাথর লুট করে নেয়া হয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় একশো কোটি টাকা। সাদাপাথর ও পার্শ্ববর্তী বাংকারে এখনো পাথর লুট চলছে।
যোগাযোগ করা হলে আব্দুল মতিন মেম্বার এ ঘটনার সাথে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবিদা সুলতানা বলেন, সাদাপাথর থেকে আনুমানিক ২০ কোটি টাকার পাথর লুট করে নেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়। তবে, কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। পাথর লুট বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানান ইউএনও আবিদা সুলতানা।