লন্ডনের চ্যাথাম হাউজে ‘এক নীতি সংলাপে’ প্রধান উপদেষ্টা
পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের অংশ হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুন ২০২৫, ১১:৫৬:১৮ অপরাহ্ন

ডাক ডেস্ক : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি কিংবা তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের কেউই আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর গঠিত নির্বাচিত সরকারের অংশ হতে চান না।
গতকাল বুধবার যুক্তরাজ্যের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউস আয়োজিত ‘এক নীতি সংলাপে’ মূল বক্তা হিসেবে অংশ নিয়ে এ মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা।
এ বিষয়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলে তিনি জোর দিয়ে বলেন, না, কখনোই না। আমি মনে করি না যে আমাদের উপদেষ্টা পরিষদের কেউ এমন আগ্রহ পোষণ করেন। তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, তাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করা।
নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে ড. ইউনুস বলেন, আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে নির্বাচনটি সঠিকভাবে হচ্ছে। এটিই আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তিনি বলেন, ‘১৭ বছর পর আমরা সত্যিকারের একটি নির্বাচন করতে যাচ্ছি, যা আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো নির্বাচন হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কমিশন তৈরি করেছি। আমরা তাদের সুপারিশের দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের কাজ হলো সব দলের ঐকমত্য তৈরি করা।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা জুলাই সনদ আসার জন্য অপেক্ষা করছি। এই সনদটি জাতির সামনে জুলাই মাসের সনদ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।’
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যদি একটি সংগঠন হত্যা, গুম এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়, তবে সেটিকে রাজনৈতিক দল বলা যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
তিনি বলেন, এটা কোনও চূড়ান্ত রায় নয়, বরং একটি বিতর্কের বিষয়।
তাঁর মতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পর মনে হয়েছিল এই অধ্যায় শেষ কিন্তু যারা দেশত্যাগ করেছিল, তারা এখনো দুঃখপ্রকাশ করেনি বরং জনগণকে উস্কানি দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, জাতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে- দেশ ও রাজনীতির নিরাপত্তার স্বার্থে বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগপর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রাখতে হবে।
আলোচনাকালে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা দাবি করেন, গণমাধ্যম এত স্বাধীনতা আগে কখনো পায়নি।
তবে আরেক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ভাঙচুর, সেক্ষেত্রে প্রশাসনের নীরবতা এবং নির্দিষ্ট দল বা ব্যক্তি বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যের প্রশ্ন তুললে ইউনূস স্বীকার করেন যে সবকিছু সঠিকভাবে সামলানো সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, এটা এমন এক ধরনের সময়কাল, যার মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি। সবকিছুই এক সাথে এসেছে। জাতীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।
বক্তব্য শেষে ইউনুসের সম্মানে চ্যাথাম হাউস একটি সংবর্ধনার আয়োজন করে, যেখানে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা অংশ নেন।
এর আগে সফরের দ্বিতীয় দিনে লন্ডনের স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় অধ্যাপক ইউনূস যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জোনাথন পাওয়েলের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি এবং জলবায়ূ পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হয়।
এরপর সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন লন্ডনের প্রভাবশালী নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের এশিয়া-প্যাসিফিক প্রোগ্রামের পরিচালক বেন ব্ল্যান্ড এবং দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. চিয়েটিজ বাজপাই।
পরে বেলা ১১টায় অধ্যাপক ইউনূস চ্যাথাম হাউসে মূল বক্তা হিসেবে অংশ নেন এক নীতি সংলাপে। চ্যাথাম হাউসের মূল হল কক্ষে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিক, গবেষক এবং গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, যুক্তরাজ্য সফরের প্রথমদিন ব্যস্ত সময় পার করেন প্রধান উপদেষ্টা।
মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটায় বিমান প্রস্তুতকারক সংস্থা এয়ারবাসসহ কয়েকটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সাথে বৈঠক করেন তিনি।
এরপর এদিন সন্ধ্যা সাতটায় বাংলাদেশ বিষয়ক অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের সাথে বৈঠক করেন তিনি। এ গ্রুপের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ এমপি আপসানা বেগম। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, এক ঘণ্টার বেশি আলোচনায় উঠে আসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ সরকারের ১০ মাসের অর্জনের বিষয়টি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের সদস্যরা এসেছিলেন প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করতে। পারস্পরিক নানান বিষয় নিয়ে এক ঘণ্টার বেশি আলোচনা হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও কথা হয়েছে গ্রুপটির সাথে।
এরপর ড. ইউনূসের সঙ্গে তার হোটেলে দেখা করতে আসেন কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল শার্লি বোচওয়ে। বৈঠকে তাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক নানা বিষয়ে কথা হয়। আজ বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। এরপর লন্ডনের সেন্ট জেমস প্যালেসে মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে শান্তি, স্থায়িত্ব এবং সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মর্যাদাপূর্ণ ‘দ্যা কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ তুলে দিবেন রাজা তৃতীয় চার্লস।
এরপর শুক্রবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথেও বৈঠকের কথা রয়েছে ড. ইউনূসের। মূলত, তার সঙ্গে নির্বাচনসহ চলমান বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনার আভাস পাওয়া গেছে।
৪দিনের এই সফরে, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র সচিব, সিনিয়র মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা এবং যুক্তরাজ্যের নীতি ও ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের সাথেও সাক্ষাৎ করবেন প্রধান উপদেষ্টা। আলোচনা হবে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বিষয়ের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সময় যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ শনাক্ত ও পুনরুদ্ধারের বিষয়েও।
সোমবার সন্ধ্যায় চার দিনের সরকারি সফরে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৫ মিনিটে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় তাকে অভ্যর্থনা জানান লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম। সকল কার্যক্রম শেষে আগামী ১৪ জুন দেশে ফিরবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।