আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মে ২০২৩, ১২:৫২:২৬ অপরাহ্ন
পাপড়ি রানী রায়
‘গ্যাং কালচারের’ নামে রাজধানীসহ অনেক এলাকায় উঠতি বয়সী ছেলেদের বেপরোয়া কর্মকা- চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। লক্ষণীয়, এসব কিশোর অপরাধ করলেও বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় তাদের অপকর্মের মাত্রা এখন সহ্যের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বখাটে কিশোরদের অপরাধমূলক কর্মকা-ের কেউ প্রতিবাদ করলে তার ওপর নেমে আসে নির্যাতন। এমনকি তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাননি সাংবাদিকও। কিশোরদের নামে অপকর্ম চললেও এসব বাহিনীতে চিহ্নিত মাদক কারবারি, ছিনতাইকারী এমনকি হত্যা মামলার আসামিও রয়েছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো- কিশোর অপরাধী চক্রের মদদদাতারা নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ের ওপর ভর করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। আর অপরাধ করার বিনিময়ে বিপথগামী কিশোরদের দেয়া হচ্ছে সামান্য কিছু উচ্ছিষ্ট অর্থ।
রাজধানীতে কিশোর অপরাধীরা সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ মানুষের কাছে আতঙ্ক হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ভয়ঙ্কর তাদের আচরণ। নিষ্ঠুরতাই তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এর জন্য দায়ী। এমন উপসংহারে আসার কারণ গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত। কিশোর গ্যাং কালচারের শিকার হয়ে ২০১৭ সালে রাজধানীতে প্রথমবারের মতো প্রাণ হারায় উত্তরা ট্রাস্ট কলেজের ছাত্র আদনান। সাম্প্রতিক জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে রাজধানীতে কিশোর অপরাধের কারণে মামলা হয়েছে প্রায় অর্ধশত। যার মধ্যে মাত্র একটি মামলার বিচারকাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। শুরুতে আড্ডা, পার্টি বা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার মতো অপরাধে যুক্ত থাকলেও সময় যত গড়িয়েছে তা বিস্তৃত হয়েছে ভয়ঙ্করভাবে। আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে জবরদখল ও মাদকবাণিজ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে বখাটে কিশোরদের।
সম্প্রতি ঈদ উপলক্ষে ‘সালামি’র নামে নীরব চাঁদাবাজি করেছে কিশোর অপরাধী চক্রগুলো। পুলিশ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, এ রকম শতাধিক গ্যাংয়ের তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্যের সংখ্যা অন্তত ৭০০-৮০০। অন্য দিকে কিশোর অপরাধী দলকে ব্যবহার করে ফায়দা নিচ্ছেন স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা। কিশোর অপরাধী দল নিয়ন্ত্রণকারী এমন অর্ধশত ব্যক্তির নামও রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। বখাটে এসব কিশোর কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে তা বোঝা যায় সম্প্রতি মিরপুরের বাউনিয়াবাদ এলাকায় শাহীন নামে এক ব্যবসায়ীর কাছে একটি কিশোর অপরাধী দলের পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায়। টাকা না পেয়ে শাহীনকে প্রকাশ্যে চাপাতি ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করে উঠতি বয়সী বখাটেরা। ওই দলের ১০-১২ সদস্য মিলে ধারালো ছুরি দিয়ে তাকে উপর্যুপরি আঘাত করে। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে মামলা হলে অভিযুক্তরা গ্রেফতার হয়। মহল্লায় মহল্লায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও বড় ভাইদের ছত্রছায়ায় দাপিয়ে বেড়ায় এসব গ্যাংয়ের অপরাধীরা।
মিছিল-মিটিং থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কাজেও ব্যবহার করা হয় এসব কিশোরকে। মাঝে মধ্যে এসব গ্রুপের সদস্যরা আটক হলেও তদবিরে তাদের তাৎক্ষণিক ছাড়িয়ে আনে মদদদাতারা। এদের পৃষ্ঠপোষক নিজেরা কিশোর না হলেও কিশোরদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে নানা অপকর্ম করায়। আমরা মনে করি, আজকের শিশু-কিশোররাই আগামী দিনে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ। তাই এসব বিপথগামী কিশোরের পথে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে রাজনীতি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে এসব কিশোর অপরাধ দমন করতে হবে। সাথে সাথে হীন ব্যক্তিস্বার্থে তাদের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে সেসব মদদদাতাকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। একই সাথে পাড়া-মহল্লায় অভিভাবকদের সন্তানদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। তবেই সম্ভব রাজধানীসহ সারা দেশে গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং কালচার রোখা। আজকের কিশোর আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের হাত ধরেই একটা দেশ উন্নতির দিকে দিকে ধাবিত হবে। কিশোর অপরাধে দায় রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা পরিবার, কেউই এড়াতে পারবে না। কিশোর সংশোধন কেন্দ্র বাড়িয়ে, দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত কর্মচারীদের মাধ্যমে কিশোরদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দরিদ্র কিশোরদের যথাযথ কারিগরি শিক্ষা, ইলেকট্রনিক ওয়ার্ক এর শিক্ষা প্রদান করতে হবে। সংশোধন কেন্দ্রগুলোর কর্মকর্তা কর্মচারীদের তদারকির ভিতরে রাখতে হবে। কিশোরদের জন্য সংশোধন কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদন ব্যবস্থা, শরীর চর্চা, ধর্মশিক্ষা, নৈতিকতা শিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে তারা সহজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে এবং একটি সুন্দর সমাজ গঠন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
লেখক : শিক্ষক।