বন্ধু
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ মে ২০২৩, ২:২২:২৬ অপরাহ্ন

আলিয়া রিফাত
অসহ্য যন্ত্রণা সাইনোসাইটিসের। পেছনের বেঞ্চে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে টুই। সিকরুমে গিয়ে একটু শুয়ে থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এই স্কুলে কোনো সিকরুমই নেই। যতটা না ব্যথায় কষ্ট হচ্ছে ওর, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে মেয়েদের চিৎকারে। এই পিরিয়ডে বিজ্ঞান ক্লাস ছিল। আপা আজ আসেননি। অফ পিরিয়ড পেয়ে ইচ্ছেমতো হাসি-গল্পে মেতে উঠেছে মেয়েরা। সবচেয়ে জোরে গলা শোনা যাচ্ছে মিথির। মেয়েটা টুইয়ের দুই চোখের বিষ। সারাক্ষণ বাঁদরামো। গতকালও গেম ক্লাসে আরেকটু হলে ল্যাং মেরে ফেলে দিচ্ছিল টুইকে। আরেক দিন জোর করেই ওর টিফিনের একটা ডিম চপ খেয়ে ফেলেছে। অনেকের সঙ্গেই এমন করে ও। ক্লাস ক্যাপ্টেন মৌ ক্লাস সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। না পেরে ক্লাসে গন্ডগোল করা মেয়েদের রোল নম্বর বোর্ডে লিখতে শুরু করেছে, প্রিন্সিপালের কাছে জমা দেওয়ার জন্য। বিরক্ত হয়ে মৌ জিজ্ঞেস করল, ‘মিথি, বোর্ডে রোল লেখার পরেও তোমার লজ্জা হচ্ছে না? কথা বলেই যাচ্ছ?’
‘লিখেই যখন ফেলেছ, তখন আর চুপ করে কী হবে?’
মিথির উত্তর শুনে ওর বান্ধবীরা আরও দ্বিগুণ উৎসাহে চিৎকার শুরু করল। এমন সময় বেজে উঠল টিফিনের ঘণ্টা। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল টুই। যাক, মাঠে গিয়ে যত ইচ্ছা চেঁচাক সবাই। কিছুক্ষণ শান্তিতে ঘুমানো যাবে।
আধা ঘণ্টা পর টিফিন পিরিয়ড শেষ হলো। একটুও সারেনি টুইয়ের মাথাব্যথা। হঠাৎ কে যেন ডেকে উঠল,‘টুই।’
বহু কষ্টে মাথা তুলে তাকাল টুই। সামনে মিথি দাঁড়িয়ে। হাতে কিছু কমলার খোসা।
‘তোমার নাকি মাথাব্যথা? নাও। এই কমলার খোসাগুলো চিপে কষগুলো চোখে দাও। সেরে যাবে।’ বলেই টুইয়ের হাতে খোসাগুলো গুঁজে দিয়ে চলে গেল নিজের বেঞ্চে। টুই হতভম্বের মতো বসে রইল কিছুক্ষণ। অনেক চিন্তা করে মিথির কথামতোই কাজ করল। চোখ অনেক জ্বালা করল ঠিকই, কিন্তু মাথাব্যথাটা উধাও হয়ে গেল ম্যাজিকের মতো। পরের পিরিয়ডগুলোতে টুই সুস্থ থাকলেও মন দিয়ে ক্লাস করতে পারছিল না। মনের মধ্যে একটা খচখচে অপরাধবোধ। ‘ইশ্, এত ভালো মেয়েটার সম্পর্কে কী সব ভেবেছি এত দিন। ছি! ওর সঙ্গে কি বন্ধুত্ব করেই ফেলব? না। আজ থাক।’
ছুটির পর ক্লাস থেকে বের হওয়ার সময় মিথিকে পেছন থেকে ডাক দিল টুই। ও ঘুরে তাকাতেই বলল, ‘ব্যথা সেরে গেছে। তোমার কমলার খোসাগুলোর জন্য ধন্যবাদ।’ মিষ্টি একটু হেসে দৌড়ে চলে গেল মিথি। সেদিন রাতে অনেক জ্বর এল টুইয়ের।
চার দিন পর স্কুলে এসেছে টুই। কাল থেকেই গ্রীষ্মের ছুটি শুরু। অ্যাসেম্বলির আগে মাঠে একটু হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। নিজের নাম ধরে কাউকে ডাকতে শুনে ঘুরে তাকাল। মিথি দাঁড়িয়ে, হাতে রাস্তা থেকে কেনা আচার। ‘তোমার নাকি জ্বর হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ। এখন ভালো।’
‘ডেঙ্গু না তো?’
‘না। এমনি ভাইরাল।’
‘যাক। বেঁচে গেছ।’
ঢং ঢং করে অ্যাসেম্বলির ঘণ্টা বাজতেই লাইন ধরার জন্য দৌড় দিল মেয়েরা। মিথিও তাড়াতাড়ি হাতের আচারটা শেষ করতে করতে ছুটে গেল সেদিকে। বন্ধুত্বের প্রস্তাবটা আজও দেওয়া হলো না টুইয়ের।
ভারি সুন্দর কার্ডটা। দুটো মেয়ে হাত ধরাধরি করে একটা বাগানে হাঁটছে। চারদিকে সুন্দর সুন্দর প্রজাপতি আর পাখি। নিচে লেখা, ‘ফর আ নিউ ফ্রেন্ড’। কার্ডটা টুই নিজেই বানিয়েছে। আজ স্কুল খুলল। ক্লাসে ঢুকে এদিক–ওদিক তাকিয়ে মিথিকে কোথাও দেখতে না পেয়ে নিজের বেঞ্চে বসল টুই। কার্ডটা রাখল বইয়ের পাশে। হঠাৎ পাশের সিট থেকে পপি ডেকে উঠল, ‘টুই, খবর পেয়েছিস?’
‘কী খবর?’
‘ওহ, তোর তো ফেসবুকও নেই। মিথি পরশু দিন মারা গেছে, জানিস।’
মাথাটা কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকল টুইয়ের।
‘কীভাবে?’
‘ছয়তলার রেলিং ছাড়া ছাদে কাজিনদের নিয়ে কানামাছি খেলছিল। পড়ে গিয়ে একদম স্পট ডেড।’
‘আঙ্কেল-আন্টির কী অবস্থা?’ কোনোমতে জানতে চাইল টুই।
‘তুই বোধ হয় জানিস না, টুই। খুব ছোটবেলায় ওর বাবা-মা একটা গার্মেন্টস দুর্ঘটনায় মারা যান। ও থাকত ওর চাচা-চাচির কাছে। রোজ ভরপেট নাশতাও জুটত না রে। এ জন্যই তো শুধু আমাদের টিফিনের দিকে চোখ দিত। আমাদের তো কত স্বপ্ন! নাইনে উঠব, সায়েন্স নেব, ডাক্তার হবÍওর ছিল শুধু ভয়। বলত, এইট পাস করলেই ওকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে। সব ভয় এখন শেষ।’
কথাগুলো বলেই টুইকে অবাক করে দিয়ে ওকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল পপি।
কিশোরী বয়সটা কেমন যেন। কিছু হলেই ছোটবেলার মতো চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সবার সামনে কাঁদতেও লজ্জা লাগে। কোনোরকমে ক্লাস করে বাড়ি ফিরেছে টুই। টিচারের কাছেও পড়ছে একেবারে না পড়ার মতো। প্রতিটা নামাজ শেষেই কেঁদেকেটে দোয়া করেছে মিথির জন্য। কিন্তু মনে শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। ওদিকে নিত্যসঙ্গী মাথাব্যথাটাও বেড়ে গেছে। বিছানায় বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ মনে হলো, ও আর নিজের ঘরে নেই। চলে গেছে ওদের স্কুল মাঠে। ঝলমলে দুপুর। ও আর মিথি হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে ওর হাতে কয়েকটা কমলার খোসা গুঁজে দিয়ে মিথি বলল, ‘টুই, আমাকে তোর মনে থাকবে তো?’
উত্তর দেওয়ার জন্য ঠোঁট নাড়তেই ঘুমটা ভেঙে গেল টুইয়ের। আধো ঘুমে পাশ ফিরতেই চমকে উঠল। বিছানার ওপর গোল, টসটসে একটা কমলালেবু! কে রাখল এটা? টুই তো ঘরে কমলা নিয়ে ঢোকেনি! ঘরের দরজা বন্ধ। ফলমূল থাকে রান্নাঘরের ফ্রিজে। বাসায় আদৌ কি কোনো কমলা আছে? টুইয়ের এসব আর ভাবতে ইচ্ছা করল না। কিছু প্রশ্নের উত্তর না পাওয়াই ভালো। বিছানায় ঢলে পড়া জোছনার নরম আলোয় কমলাটা হাতে নিল টুই। পরম মমতায় ওটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সব সময়।’
২০ বছর ধরে কবরস্থানের দেখাশোনা করছেন খোকন মিয়া। ভোরে দাঁত ব্রাশ করতে করতে হেঁটে যাচ্ছিলেন নতুন কবরটার পাশ দিয়ে। বারো-তেরো বছরের এক মেয়েকে শোয়ানো হয়েছে এখানে। কবরের মাটি এখনো ভেজা। কিন্তু কবরের ওপরে ওটা কী? কার্ড! অবাক হয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কার্ডটা তুললেন খোকন মিয়া। হাত ধরাধরি করে দুটো মেয়ে হাঁটছে। নিজে ইংরেজিতে কী সব লেখা কিছুই বুঝতে পারলেন না।