জনজীবনে শব্দদূষণের প্রভাব
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২০ মে ২০২৩, ২:২৫:০৪ অপরাহ্ন
মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
ভয়াবহ শব্দদূষণের কবলে নগরজীবন। ভয়াবহ শব্দদূষণের কবলে দেশের রাজধানী ঢাকাসহ সিটি করপোরেশনগুলো। শুধু সড়কেই নয়, বরং আবাসিক বা নীরব এলাকায় উচ্চ শব্দের হর্ণ বাজিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যানবাহন। শব্দদূষণের কারণে ৪২ ভাগ রিকশাচালক ও ৩১ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ কম শুনছেন কানে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত শব্দদূষণ শুধু শ্রবণশক্তিই নষ্ট করে দিচ্ছে না, বাড়িয়ে তুলছে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি ও মানসিক রোগসহ নানা শারীরিক ও মানসিক জটিলতা। কমিয়ে দিচ্ছে সন্তান জন্মদানের ক্ষমতাও। লোপ পাচ্ছে শিশুর মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা।
শব্দদূষণে প্রথম আক্রান্ত হয় কান বা শ্রবণশক্তি। শ্রবণশক্তির সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। অসংখ্য মানুষ এখন হিয়ারিং এইড ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। শব্দদূষণের কারণেই বাড়ছে বধির মানুষ। এছাড়া শব্দদূষণের কারণে স্মৃতি লোপ, হাইপার টেনশন, এমনকি ব্রেন টিউমারেও আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। শব্দদূষণে আক্রান্ত হয় মস্তিষ্ক। দীর্ঘ সময় উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকলে কম শোনা, মাথাঘোরাসহ নানা শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়। দৈনিক ৬ ঘন্টার বেশি উচ্চ শব্দের মধ্যে টানা পাঁচ সাত বছর থাকলে স্থায়ীভাবে বধিরতা সৃষ্টি হতে পারে। কানের ভিতরের রিসেপ্টর শব্দ তরঙ্গ ধারণ করে ককলিয়ার নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছায়। দীর্ঘদিন অতিরিক্ত শব্দ এ রিসেপ্টরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দিনের পর দিন লম্বা সময় ধরে কেউ ৭০ ডেসিবলের ওপর শব্দের মধ্যে থাকলে তার শ্রবণশক্তি ক্রমেই কমতে থাকে। তিনি যে বধিরতায় ভুগছেন তা অনেক সময় নিজেও টের পান না। সারাক্ষণ হর্ণ বাজানো গাড়িচালক নিজেই বেশি ক্ষতির শিকার। তবু অসচেতনতার কারণে তিনি হর্ণ বাজান। এছাড়া মোবাইলের ভলিউম বাড়িয়ে দীর্ঘ সময় কথা বললে কানের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। শহরে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ ঘটাচ্ছে গাড়ির হর্ণ। কনসার্ট, হাইড্রোলিক হর্ণ, অ্যাম্বুলেন্সের হর্ণ, নির্মাণ কাজে পাথর ভাঙা, টাইলস ও রড কাটায় উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ হচ্ছে। আবাসিক এলাকায় ঘরের ভিতরে থেকেও গাড়ির হর্ণ, নির্মাণ কাজ বা মাইকের শব্দে মানুষ শব্দদূষণের শিকার হচ্ছে।
অতিরিক্ত শব্দ গুরুতর মানসিক রোগের উৎস। কারণ উচ্চ শব্দ দৈনন্দিন জীবনে সৃষ্ট নানা ধরনের মানসিক চাপ মোকাবেলায় বাধা দেয়। চাপ সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে মানসিক সুস্থতা বাধাগ্রস্ত হয়। দৈনন্দিন জীবনে মানুষ প্রতিনিয়ত নানা চাপের মধ্য দিয়ে যায়। এ চাপ মোকাবিলায় একটা ক্ষমতাও তার থাকে। তবে সে ক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন সুস্থ পরিবেশ। উচ্চমাত্রার শব্দ সে পরিবেশ নষ্ট করে দেয়। উচ্চ শব্দ বিরক্তির উদ্রেক করে, রাগ ও চাপা উত্তেজনা তৈরি করে। তখন মানুষের মনের চাপ মোকাবিলায় বাধা তৈরি হয়। মানুষের মস্তিষ্ক সারাক্ষণ সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সংকেত দেয়। এ জন্য হঠাৎ অনেক জোরে শব্দ হলে মানুষ ভয় পায়, কেঁপে ওঠে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। অর্থাৎ উচ্চ শব্দকে মস্তিষ্ক বিপদ মনে করে। শব্দ তাই মনে চাপ ও উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। উদ্বেগ নিদ্রাহীনতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। অন্যদিকে আবাসিক এলাকায় শব্দের কারণে ঘুমের ব্যঘাত ঘটে। আর মস্তিষ্ক সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম অপরিহার্য। শব্দের কারণে সৃষ্ট উদ্বেগ ও নিদ্রাহীনতায় একজন ব্যক্তির মেজাজ খিটখিটে হতে পারে। রাগ বেড়ে যেতে পারে। মনোযোগ দিয়ে কাজ করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। শিশুদের শেখার ক্ষমতায় প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া মানসিক চাপ ও নিদ্রাহীনতা শরীরের নানা অঙ্গকে প্রভাবিত করে। যিনি গাড়ির হর্ণ বা মাইক বাজাচ্ছেন, তিনি নিজেও একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই সবাইকে সচেতন হতে হবে।
শিশুদের ওপর শব্দদূষণের প্রভাব মারাত্মক। কারণ, তাদের মস্তিষ্ক প্রস্ফুটন বা গঠনের পথে থাকে। শব্দদূষণ এই গঠন বাধাগ্রস্ত করে। শিশুর শেখার ক্ষমতা কমে যায়। কথা বলতে দেরি হয়। আচরণেও প্রভাব ফেলে। এছাড়া শব্দদূষণ বড়দের স্ট্রোকের ঝুঁকি ৩০ ভাগ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। আমাদের দেশে শব্দদূষণের চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ। আবাসিক এলাকায় অনুমতিযোগ্য শব্দের মাত্রা সর্বোচ্চ ৫৫ ডেসিবল (ডিবি)। বাণিজ্যিক এলাকায় সর্বোচ্চ ৭০ ডিবি। গত ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) প্রকাশ করা প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণের শিকার ঢাকার বাসিন্দারা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকায় গড়ে শব্দের মাত্রা ১১৯ এবং রাজশাহীতে ১০৩ ডিবি (ডেসিবল), যা একজন মানুষের কানের সহ্য ক্ষমতার অনেক বেশি। স্ট্রোকের সঙ্গে শব্দদূষণের সম্পর্ক নিয়ে স্পেনে এক গবেষণায় দেখা গেছে, শব্দদূষণ বেশি হলে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৩০ ভাগ পর্যন্ত বাড়ে। বেশি শব্দের মধ্যে স্ট্রোক হলে সেটার ভয়াবহতাও বেশি হয়।
ডেনমার্কের ৩ হাজারের মতো নার্সিং স্টাফের ওপর ১০ বছর ধরে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের মধ্যে প্রায় ১ হাজার নার্স স্ট্রোক করেছেন। স্ট্রোক হওয়া নার্সদের অধিকাংশই বেশি শব্দদূষণের মধ্যে বাস করতেন। আমেরিকার স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সহ্যসীমার পর প্রতি ১০ ডেসিবল শব্দদূষণ বাড়লে যেকোনো বয়সের মানুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ১৪ ভাগ। আর ৬৫ বছরের বেশি বয়স্কদের ঝুঁকি বাড়ে ২৭ ভাগ। মূলত: উচ্চ শব্দে শরীরে অ্যাড্রেনালিন বা স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। এটার পরিমাণ বেশি হলে রক্তচাপ বাড়ে। আর উচ্চ রক্তচাপ সব অসুখের মূল। শব্দদূষণ উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। আর সেই উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বড় শত্রু। এতে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি করে।
বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতায় শব্দ অপরিহার্য। কিন্তু শব্দের মাত্রা যখন স্বাভাবিকতা হারিয়ে অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছে তখনই সেটা হয় শব্দদূষণ। শব্দদূষণ আজ মানব সভ্যতার এক ভয়ংকর বিপদ। সেই শব্দদূষণ রোধে সকলে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং সকলকে সচেতন হতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক।