সম্প্রীতির কবি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ মে ২০২৩, ৭:০৯:২১ অপরাহ্ন
পাপড়ি রাণী রায়
সমাজবদ্ধ মানুষ নানা ধর্ম নানা গোত্রে বিভক্ত। ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা কিন্তু এক নয়। সকল ধর্মের মূল কথা মৈত্রী, প্রেম, শান্তি, সম্প্রীতি। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। মান আর হুশ আছে বলেই তো মানুষ অন্য প্রাণী থেকে আলাদা। মানুষ সচেতনতায়, বুদ্ধিমত্তায়, স্বতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠ। আর এ শ্রেষ্ঠত্বকে বজায় রাখতে হলে মানুষকে অবশ্যই বিবেকবান এবং মানবতাবাদী হতে হবে।
মানবতাবোধকে মূল্য দিতে হলে সমাজের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা যেন সমাজের জন্য অমঙ্গল হয়ে দেখা না দিতে পারে তার জন্য সচেতন থাকা চাই। সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো মানুষ। তাঁর সৃষ্টিতে নেই কোন ভেদাভেদ বৈষম্যের পার্থক্য রেখা।
কবি নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালে ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে এক পীর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির মোহাম্মদ, মাতার নাম জাহেদা খাতুন। কবি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সঙ্গীত ¯্রস্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
পুরান-কোরআন, গীতা মহাভারতের গভীর জ্ঞান এবং আরবি-ফারসি, সংস্কৃত, বাংলা শব্দ ভা-ারের চাবিকাঠি ছিল তাঁর হাতে। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু, মানুষের উপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ।
বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলাম এর মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। সত্যের পূজারী কবি কন্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়েছে, সর্বকালের এক বরণীয় অমোঘ বাণী- গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
মানুষই হলো জনক। একসময় মানুষ ছিল প্রকৃতির দাস। কিন্তু আজকের দিনে মানুষই নিয়ন্ত্রণ করেছে প্রকৃতিকে। মেধা ও বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ পৃথিবীকে জয় করেছে। মানুষের আছে প্রবল ইচ্ছাশক্তি। এই ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ জল, স্থল, অন্তরীক্ষে উড়িয়েছে বিজয় নিশান। মানুষের কাজের গতিকে বাড়িয়ে মানুষ সভ্যতার নান্দনিকতা সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞানের নবনব আবিষ্কার তা মানুষই সৃষ্টি করেছে।
মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। দূরত্বকে কাছে টেনে এনেছে মহাশূন্যের রহস্য উদঘাটনে মানুষ আজ সক্ষম। মানুষ সেই চেষ্টায় মনোযোগী কী করে সহজ থেকে সহজতর জীবন যাপন করা যায়। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, স্বভাবতই মানুষ নিজেকে জাহির করার জন্য যতোটা তৎপর, পরকে আপন করতে ততটা তৎপর নয়।
ধর্মীয় গোঁড়ামি কুসংস্কারের কারণে পৃথিবীর মানুষ বহু ধারায় বিভক্ত। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষের কারণে একে অপরের জন্য শুভ চিন্তা করতে পারে না। এক সম্প্রদায়ের মানুষ আরেক সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যুদ্ধ পর্যন্ত করতে প্রস্তুত থাকে। বিজ্ঞানের নতুন নতুন উদ্ভাবন প্রয়োগ করে একে অপরের বিপক্ষে। এমনকি, শক্তিশালী মারণাস্ত্র দ্বারা ধ্বংস করা হচ্ছে মানবসভ্যতা। এক প্রকান্ড প্রভেদের চেয়াল গড়ে ওঠেছে। একশ্রেণির মানুষ টাকার পাহাড় গড়ে তুলছে, আরেক শ্রেণির মানুষ অনাহারে, অর্ধাহারে ধুকে ধুকে দিন যাপন করছে। অন্ন নাই, বস্ত্র নাই, মাথা গুজবার ঠাঁই নাই। রাস্তার ফুটপাতে মানুষ কত নিদ্রা যায়। এই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবার কেউ নাই। এই বস্ত্রহীন, অন্নহীন গৃহহীন মানুষ জানে পৃথিবীতে কি রকম অসহ্য কষ্ট করে তাদের দিন রজনী কাটে।
জাতি ধর্ম এবং বর্ণ ভেদের কারণে সারা পৃথিবীতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অন্যায় অবিচারের স্বীকার হচ্ছে। যেন মানবতা ও মানবিকতা ভূলুন্ঠিত। সারা পৃথিবীতে মানুষ বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত থাকলেও মানুষের পরিচয় একটাই আর তা হলো আমরা সবাই মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, জাতিতে আলাদা কিন্তু সকলের ধমনীতে একই রক্ত প্রবাহিত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় কোন মুমূর্ষ রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলে নিজ আত্মীয়ের রক্তের গ্রুপ না মিললে তৎক্ষণাৎ বাইরে থেকে যোগাড় করে রক্ত দিয়ে ঐ শয্যাশায়ী রোগীকে সুস্থ করা হয়। আর তখন কিন্তু আমরা ভেদ-বিচার করি না।
সৃষ্টি জগতে সবার উর্ধ্বে মানুষের ঠাঁই। ধর্মীয় গোঁড়ামি কিংবা সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবলে আক্রান্ত হয়ে কাউকে খাটো করে দেখার কোন বীরত্ব বা বাহাদুরী নাই। সকল মানুষকে সমান চোখে দেখতে হবে। মানুষের পরিচয় একটাই জগৎ জুড়ে এক জাতি আছে, আর সে জাতির নাম মানুষ জাতি। মানবতা আর মনুষ্যত্বকে যদি মানুষ সবার উর্ধ্ব স্থান দেয় তাহলেই পৃথিবীতে পরিপূর্ণ শান্তি বজায় থাকবে এবং পৃথিবী হবে সবার সুন্দর।
সত্যের পূজারী কবি নজরুল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি। একদিন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ নিজেই এ নবীন কবির তূর্যনিনাদে বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছিলেন। নজরুলের প্রকাশিত বিদ্রোহী কবিতার আবৃত্তি শুনে তিনি স্তব্ধ বিস্ময়ে কবির মুখের দিকে চেয়েছিলেন। তারপর রবি ঠাকুর আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার কবিতা শুনে। তুমি যে, বিশ্ব বিখ্যাত কবি হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। তোমার কবিত্ব প্রতিভায় জগৎ আলোকিত হবে, ভগবানের কাছে এ প্রার্থনা করি।
নজরুল ইসলাম নির্যাতিত মানবতার মুক্তির গান গেয়েছেন। কুলি, মজুর, বীরাঙ্গণা কাউকেই তিনি ঘৃণা করেননি। বরং সকলকে একই সমতলে দাঁড় করিয়ে একমাত্র মনুষ্যত্বের মানদ-ে তাদেরকে বিচার করতে চেষ্টা করেছেন। সংস্কার ও বিধি নিষেধের গ-ি চূর্ণ করে তিনি সকল মানুষকে সমান মর্যাদা দেওয়ার প্রেরণা দিয়েছেন। নজরুল কাব্যে মানবতার জয়গান সুস্পষ্ট কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য নজরুল সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। কোনো সম্প্রদায়ের সমাজে তিনি মানুষকে বন্দি করেননি। শৃঙ্খলিত, নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম, হতভাগ্যের জাগরণ, পদানত শোষিত মানুষের মুক্তি প্রত্যাশায় তিনি মানুষকে জাতি ধর্ম সমাজ, মন্দির-মসজিদ ও গ্রন্থের উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন, মানবতার সপক্ষে বাজিয়েছেন সাম্যের সুরধ্বনি।
যেখানে অন্যায়-অবিচার সেখানেই নজরুল ছিলেন সোচ্চার। ভারতের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা দমনে নজরুলের অবদান অনস্বীকার্য। নজরুল সুদূর চিন্তা করেছিলেন, সাম্প্রদায়িক কলহের দুর্বলতা দিয়ে ভারতের মুক্তি সম্ভব নয়। নজরুল এ কারণেই ভারতীয়দের শক্তির দুর্বলতার সূত্রগুলো ‘যুগবাণী’ ও অন্যান্য পর্বের সম্পাদকীয় রচনায় বিশ্লেষণ করেছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে জানতেন, হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ শক্তির দুর্বার আঘাতেই ব্রিটিশ শাসন শৃঙ্খল ভাঙা সম্ভব। নজরুল তাই আহ্বান জানিয়েছিলেন, ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের।
ভেদ, জ্ঞান দূর করতেই নজরুল বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কবিতা ও প্রবন্ধে সাম্য, কল্যাণ ও ঐক্যের বাণী শুনিয়েছিলেন। মানবতা আর মনুষ্যত্বকে যদি মানুষ সবার উর্ধ্বে স্থান দেয়, তাহলে পৃথিবী সুন্দর হবে। মানুষের উচিত, সকল বিভেদ, বৈষম্য ভুলে গিয়ে অভিন্ন পৃথিবী গড়ে তোলা। কবি নজরুলের সুরে ধ্বনিত হউক সম্প্রীতির বন্ধন এমনটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষক