ভূত বানরের যুদ্ধ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মে ২০২৩, ২:৫১:০০ অপরাহ্ন
মো. আশতাব হোসেন
সীমান্তবর্তী এই বিলের নাম দার ডাঙ্কার। এর কিছু অংশ ভারতে, কিছু অংশ বাংলাদেশে পড়েছে। দুই দেশের লোকজনই মাছ ধরে। দরিদ্র লোকেরা বিক্রিও করে। তবে কেউ কারও দেশের সীমানা অতিক্রম করেনা। সারাবছরই পানি থাকে। সাথে কচুরিপানাও গিজগিজ করে। যেখানে অনেক গভীর সেখানকার পানিগুলি কালো,নিচের দিকে তাকালে মনে হয় তলা নেই। ভয়ে গা ছমছম করে ওঠে! পাশেই আছে মন্ডলদের বিশাল এক বাঁশ ঝার। আর সেখানেই সব গোন্ডগোল! আশপাশে গ্রামের লোকেরা বড় ঝাঁড় নামে চিনে। সেই বনে অন্যান্য গাছও আছে। এক পাশে আছে বেতের ঝাড়। দিনের বেলায়ও সেখানে ঢুকতে ভয় লাগে। ভিতর থেকে মনে হয় সূর্য ডুবে গেছে।
না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না।
বাঁশঝাড়ের পাশেই মহাশশ্মানঘাট। পরিস্থিতি দেখলে মনে হয় আসলেই ওটা ভূতেরই বিশাল রাজ্য! শশ্মানঘাটটি ভারতের অংশে পড়েছে। হিন্দু ধর্মের কেউ মারা গেলে এখানে লাশ দাহ করা হয়।
বিশালাকার বিল। পাশে বড় বাঁশঝাড়। তার সাথেই আবার শশ্মানঘাট। শুনতেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়!
সেখানে বিভিন্ন প্রজাতি পশুপাখিও স্থায়ীভাবে বাসা করে থাকে আর ভূতের তো স্বাধীন রাষ্ট্রই বলা চলে। ভূতগুলি বেশি আড্ডা জমায় শশ্মানঘাটের আশেপাশেই এমন জনবসতিহীন এলাকা পেয়ে ভূতদের আর খুশির সীমা নেই। খুব আনন্দ ফূর্তিতেই কেটে যায় দিনরাত। ভূতদের আবার প্রধান খাদ্য হলো শশ্মানের লাশের, পোড়া কয়লা। তাদের নিকট কয়লা হলো খুবই মজাদার উন্নত খাবার। যে দিন লাশ পোড়া গন্ধ পায় সে দিন দূরদূরান্ত থেকে চলে আসে অন্য ভূতেরাও। সেখানে স্থায়ীভাবে সে সকল ভূত বসত করে তাদের আত্মীয়স্বজন কেউ দূরে থাকলে তাদেরও নিমন্ত্রণ করে আসার জন্য। তবে লাশ যখনই দাহ হোক না কেনো কয়লা খায় রাত হলেই। লাশ পোড়ানো শেষ হলে ভস্ম ও কয়লা সব ধুয়ে ফেলে দেয় ডাঙ্কার স্রোতহীন বিলে। কয়লা সব ভাসতে থাকে। রাতে সব ভূত একযোগে পানিতে নেমে কয়লা খাওয়া শুরু করে, যারা আগে যায় তারা পেট পুরে খায়। পরে যারা যায় তাদের ভাগ্যে কয়লা না জুটলেও সমস্যা হয়না। ভূত পেতœীরা যেখানে লাশ পোড়ায় সেখানে শুকলেও নাকি তাদের পেটের ক্ষুধা মিটে যায়। আর পেতœীরা তো সেখানেই সারা দিনরাত ঘুরঘুর করে। তারা ভূতদের খুব ভয় পায়, ঘনঘন নমস্কারও দেয়। পেতœীদের কপাল পোড়া কয়লা জোটেনা কখনও তারা গন্ধ নিয়েই পেট ভরায়। কিছু দিন লাশ পোড়া বন্ধ থাকলে ভূতদের বড় জ্বালা হয়। তখন রাতে বের হতে হয় কাঁকড়ার সন্ধানে বিলের পাড় দিয়ে। পানির কাছাকাছি থাকে কাঁকড়ার অনেক গর্ত, সেই গর্তে হাত ডুকিয়ে দিয়ে তুলে এনে ছোট বড় কাঁকড়া হাত-পাসহ মুখে পুরে দিয়ে মড়মড় শব্দ করে খায়, মাঝে মাঝে ভূতের কাঁকড়া খাওয়ার শব্দ শুনে আশপাশ থেকে শেয়াল দৌড়ে আসে। কারণ শেয়াল আবার কাঁকড়া খেতে বেশি পছন্দ করে। তবে শেয়াল বুঝতে পারেনা ভূত যে পানির উপর দিয়েও সোজা চলতে পারে। তাই ভূতেরা যখন কাঁকড়া খাওয়া শুরু করে শেয়ালের না খেয়ে থাকতে থাকতে অবস্থা প্রায় মরমর!
যেখানে শেয়াল যায়, গিয়ে শব্দ শোনে কারা যেনো সব খেয়ে ফেলছে। শেয়াল শব্দ মড়মড় শব্দ শুনেই হুক্কাহুয়া ডাক দেয় আর তখনই ভূত সব পানির উপর দিয়ে হেটে অন্যপাড়ে যায়। এভাবেই পরবর্তী লাশ পোড়ানোর আগে শেয়ালদের কষ্টেই দিন কাটে।
ভূত চলার পায়ের ছাপ দেখা যায়না কিন্তু শেয়ালের দেখা যায়। এক্ষেত্রেও শেয়ালের আর এক জ্বালা, ভূতেরা লক্ষ্য করে মাটির দিকে শেয়াল এসেছিলো কিনা। যেখানে শেয়ালের পায়ের ছাপ দেখে সেখান থেকে ভূত সব অন্যত্র গিয়ে খায়। এজন্য ভূতের বেশি সুবিধা হয়।
ভূতেরা খুব চালাক নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বা অন্য প্রাণীদের বিরক্ত করার জন্য নিজেদের হেফাজতে রেখে দেয় মাঠের শুষ্ক মাটির দলা, ইটের ছোট ছোট টুকরা।
বনের অনেক পশু পাখি দিনে আহার সেরে রাতে ঘুমায়; তারা রাতে ঘুমিয়ে পড়লে ভূতেরা ঢিল ছুঁড়ে মারে গাছের উপরে। তাতে অনেকের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আবার পাখিদের বাসায় ছোট বাচ্চা ও ডিম থাকলে নিচে পড়ে ভেঙ্গে যায়। বাচ্চাগুলিও মরে যায়। ভূত গাছের নিচে এসে সেসব মজা করে খায়। এভাবে কিছুদিন চলতে চলতে পশুপাখিরা অতিষ্ট হয়ে বনের সব পশুপাখি এক সভা ডাকে। সভাতে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়। আবার ভূতেরা এমন জঘন্য কাজ করলে ছাড় দেয়া হবেনা। সবাই গাছে কাঁচা গাব-বেল ছিঁড়ে এক যোগে ঢিল ছুঁড়তে হবে। বানর তখন বলে আরে রাখ! ভূতকে কীভাবে ঠিক করতে হয় তা আমার জানা আছে। ওদের চোদ্দগোষ্ঠী বন ছাড়া করবো। এই বলে বানর গাছের মরা ডাল, কাঁচা বেল, গরুর মরা হাড্ডি সব জোগাড় করে গাছের ডালের চিপায় রাখা শুরু করে দেয়।
সবাই বানরের কর্মব্যস্ততা দেখে হাসে আর বলে বানরই সব পারবে।
বানর সবাইকে বলে দিলো আমরা দুষ্টামি শুরু করলে বেখেয়ালি হয়ে যাই। তাই যখন ভূত এসে একটা ঢিল মারবে তখনই তোমরা সবাই চেঁচামেচি করে বন তোলপাড় করে ফেলবে। তখনই শুরু হবে খেলা!
ভূতেরা পূর্বের মতো গাছে যেই ঢিল ছুঁড়ে প্রথমেই গিয়ে পড়ে কাকের বাসায়। কাকের কণ্ঠ তো সবারই জানা আছে। কাক বিকট শব্দে যখন কা, কা… চিৎকার শুরু করে,সবার এক সাথে নিদ্রা জলে যায়। বানর গাছে দোল খাওয়া ছেড়ে শুরু করে গাছের উপর থেকে ঢিল ছোঁড়া যা হাতের কাছে যা পায় তাই ছুঁড়ে মারে নিচের দিকে। চার দিক থেকে সব পখিরা শুরু করে নব বিজয়ে চেঁচামেচি। ভূতেরা নিচ থেকে অনেক সময়ব্যাপী ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছু হটে যায়। কারণ উপর থেকে ঢিল ছুঁড়লে মাথায় এসে লাগে। আর বানরের হাত খুবই দক্ষ, মিস হয়না।
ভূত একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে বন ছেড়ে শশ্মানের আশে পাশে গিয়ে সাময়িক আশ্রয় নেয়। পরে চলে যায় যে যেখানে সুযোগ পায় সেখানে।
বানরের দাপটে সব ভূত সেই দিন থেকেই বড় ঝাড় ছেড়ে পালায়!