শিল্পায়নে হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান গ্রামবাংলা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মে ২০২৩, ৭:৪৭:১১ অপরাহ্ন
অন্জন কুমার রায়
বেশি দূরে নয়, সিলেট থেকে শতেক কিলোমিটার। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ ও মাধবপুর উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে শিল্প-কারখানা। এ এলাকাতেই আমাদের চিরচেনা গ্রাম যেখানে ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছি। পড়ালেখা এবং চাকরির সুবাদে শহুরে জীবনকে ধারণ করতে দীর্ঘদিন গ্রামের বাইরে কাটিয়ে দিলাম। প্রাত্যহিক জীবনের ছন্দ মনে করিয়ে দেয় চিরচেনা গ্রামের দৃশ্য। গ্রামের স্নিগ্ধ মনোরম প্রকৃতি অনেকটা ইটের টুকড়ায় বন্দি হয়ে যেতে দেখেছি। সেখানে আর শত শত গাছগাছালি নেই। পাখির কল-কাকলিতে ঘুম ভাঙে না, ঘুম ভাঙে মেশিনের শব্দে! সকালের রোদটুকু হারিয়ে যায় অচেনা শহুরের আবেশে। সন্ধ্যার পর রাস্তায় দেখতে পাওয়া যায় হাজার হাজার কর্মব্যস্ত মানুষকে। এখন আর সারি সারি বৃক্ষ চোখে পড়ে না। গ্রামীণ আবহের নিস্তব্ধতা হারিয়ে নতুন করে গড়ে উঠেছে শিল্পায়ন। গ্রাম বাংলার যে ঐতিহ্যকে ধারণ করে বড় হয়েছি সবই বিলীন হয়ে গিয়েছে শিল্পায়নের ছোঁয়ায়। পূর্ণিমা রাতে এক ফালি চাঁদের দেখা মেলা ভার। সবই যেন বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় ঝলসে গেছে। স্নিগ্ধ আবেশে শীতের সকালে কুয়াশা দিন দিন ধোঁয়াশায় পরিণত হচ্ছে। কৃষি জমিতে কল-কারখানা স্থাপনে কৃষি জমির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে।
গ্রামের স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ এখন আর চোখে পড়ে না। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকা গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। বাঁশঝাড়গুলো উজাড় হয়ে গেছে। শরৎকালে কাশবনগুলো আগেকার মতো মুগ্ধতা ছড়ায় না কিংবা পাতা ঝরা ফাগুণের উষ্ণ আলিঙ্গন অনুভূতি জাগায় না। সন্ধ্যাবেলায় যে পাখিগুলো নীড়ে ফিরে আসতো তা চোখে পড়ে না। সবই যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে শিল্পায়নের ছোঁয়ায়। সবকিছু শহুরে খাঁচায় বন্দি জীবন। বেরসিক জীবনকে সকলেই চলমান পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। পাড়ার যে লোকগুলো ভোর বেলায় গরু নিয়ে মাঠে যেত তারা এখন রাত অবধি কারখানায় কাজ করে। ক্লান্তি তাদেরকে হার মানাতে পারে না। যে কৃষক কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো তারা এখন কারখানায় কাজ করে সংসার চালায়। খুবই অল্প সংখ্যক কৃষক ঐতিহ্যগতভাবে তাদের পেশাকে ধরে রেখেছে। তাই, ধান চাষ হলেও শীতকালীন ফসলের আবাদ কমে আসছে। ফলে, অনেক কৃষিজমি পতিত থেকে কৃষি অর্থনীতি ব্যাহত হচ্ছে।
শিল্পায়নের ছোঁয়ায় সেখানকার অবস্থায় আমুল পরিবর্তন হয়েছে। উন্নয়ন হয়েছে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ির। পূর্বের তুলনায় ব্যবসায়িক কর্মকা- বেড়েছে বহুগুণে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ কল-কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাই প্রতিদিন হাজারো লোকের সমাগম হয়। নিস্তব্ধ গ্রামগুলো এখন ব্যস্ততায় ভরপুর। কিন্তু, শীতল স্নিগ্ধ বাতাস দুষিত করে তুলছে শিল্পায়নের ডামাঢোলে। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ সেখানকার মনোরম পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছে। বহমান নদীতে চর জেগে আছে। নদীর ঘাটে সারি সারি নৌকা বাঁধা থাকে না। নদীর পানি দূষিত হয়ে কালছে রং ধারণ করছে। ছোট ছোট খালগুলো অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে। তাই, নদী কিংবা খালে মাছের দেখা পাওয়া ভার। পাশে রয়েছে রঘুনন্দন পাহাড়। পাহাড় এবং রেল লাইনের পাশে রয়েছে ময়লার ভাগাড়। মেশিনের শব্দ এবং মানুষের সরব উপস্থিতিতে প্রাণীদের অভিযোজন ক্ষমতা কমে ্আসছে। তাই সেখানকার প্রাণীরা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মুলত, জীবিকার তাগিদে আমরা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য হারাতে বসেছি। প্রশান্তিময় গ্রাম বাংলার খোলাহল মুখর পরিবেশ সেখানে নেই।
তারপরও হাজারটা প্রশ্ন উপেক্ষা করে মেতে উঠি সম্ভাবনাময় শিল্পায়ন নিয়ে। একদিকে মেশিনের শব্দ অন্যদিকে হাজারো অচেনা মানুষের কর্মসংস্থান। সকালবেলায় হাজারো লোক উৎপাদন কারখানায় নিয়োজিত থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজ করে। তাদের ক্ষুদ্র হাতে গড়া পণ্য দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাচ্ছে। তাদের শ্রম দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সাহায্য করছে। গ্রামের কেউ আর বসে থেকে অলস সময় পার করে না। বেকারত্ব ঘুচে সকলেই এখন স্বাবলম্বী। গাঁয়ের মেঠোপথ এখন পিচঢালা পথে পরিণত হয়েছে। রাস্তা-ঘাটের উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে। মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চিকিৎসা সেবা সহজলভ্য হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার সুযোগ বহুলাংশে বেড়েছে। ফলে, শিক্ষার হারও বেড়েছে। সর্বোপরি মানুষের জীবন মানের অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
তবে, গ্রামের মানুষগুলো ফুটবল, ক্রিকেট, হা-ডু-ডু খেলায় কোন আনন্দ খোঁজে পায় না। চিরচেনা রাখালের গরুর পাল চোখে পড়ে না। কেউ বাঁশি বাজিয়ে চৈত্রের দুপুরটাকে মাতিয়ে রাখে না। গ্রীষ্মের দুপুরে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায় না। হেমন্তকালে নতুন ধানের পিঠা বানানোর আমেজ অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। শীতকালে এখন আর যাত্রা-পালা হয় না। বৈশাখ কিংবা পৌষ মাসে মেলার আয়োজন থাকে না। অথচ গ্রামই প্রাণ, গ্রামই আমাদের বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। তাছাড়া শিল্প ও সংস্কৃতির সূক্ষ মেলবন্ধন গ্রামের পটভূমিতেই ধরা দেয়। অথচ শিল্প ও সংস্কৃতির মৌলিকতা শিল্পায়নের প্রভাবে সেখানে আজ হারাতে বসেছে। ফলে সেখানকার মানুষদের জীবন থেকে গ্রামীণ সংস্কৃতি বিলুপ্ত হচ্ছে।
শিল্পায়নে যেমন সেখানকার জীবনমান উন্নত হয়েছে তেমনি তৈরি হয়েছে নানা মাত্রিক জটিলতা। পারস্পারিক সম্পর্ক এখন টিকে আছে মুঠো ফোনের ছোঁয়ায়। তাই, সম্প্রীতিকে সুদৃঢ করার পরিবর্তে হারাতে বসেছি যা আমাদের চিরায়ত সমাজ ব্যবস্থাকে ক্ষয়িষ্ণু করে দিচ্ছে। মুলত, আমরা গ্রামের সে দিনগুলো হারাতে বসেছি, যে দিনগুলোয় সমাজের একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়াতো। সামাজিক হৃদ্যতা হারিয়ে সকলেই এখন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছি।
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। রূপ বৈচিত্র্যের এদেশে হাজার বছরের আবহমান গ্রামবাংলার বিভিন্ন ঐতিহ্য ধরা পড়ে গ্রামীণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এদেশের কৃষ্টি, কালচার মিশে আছে গ্রাম বাংলার মানুষের মনে প্রাণে। তাই গ্রাম বাংলার মানুষ তার নিজস্ব ঐতিহ্য ধারণ ও লালন-পালন করে আসছে আবহমানকাল থেকেই। কিন্তু, শিল্পায়নের ছোঁয়ায় আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির আমেজ থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। খড় কিংবা টিনের ঘরের পরিবর্তে তৈরি হচ্ছে বহুতল বিশিষ্ট নতুন নতুন ভবন। সেখানে অতি পরিচিত বাঁশঝাড় কিংবা বনলতার শ্যামল স্নিগ্ধ আমেজ আর নেই। অথচ, গ্রামের সে মেঠোপথকে আপন বলে জেনেছি; যে পথে বর্ষাকালে কাদা, শীতকালে ধুলো থাকে। কিন্তু আজ আর তা দেখা যায় না। শিল্পায়নের ছোঁয়ায় রাস্তাগুলো পিছঢালা পথে পরিণত হয়েছে। মানুষের জীবন মানেরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু ¯িœগ্ধ কোলাহলযুক্ত নির্মল বায়ুর দেখা মেলে না।
প্রকৃতির সঙ্গে উন্নয়নের পরিমিতবোধ পরিবেশকে অনিন্দ্য সুন্দর করে তোলে। কিন্তু, শিল্পায়নের ছোঁয়ায় সে বাঁধন না থাকায় আমরা আজ তা হারাতে বসেছি। অথচ, আমাদের সংস্কৃতির রূপায়নে গ্রামের আবহকে অনন্য রূপে বার বার তোলে ধরি। আমরা চাই শিল্পায়নের মাঝে গ্রামীণ অবয়ব আরও অনিন্দ্য সৌন্দর্য্যের হাতছানি দিয়ে ডাকবে। তবেই তা হবে প্রকৃতির জন্য বিশালত্বের ছোঁয়া।
লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা।