শায়খুল হাদীস মুহিব্বুল হক গাছবাড়ি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মে ২০২৩, ৭:৫১:০৪ অপরাহ্ন
বেলাল আহমদ চৌধুরী
মুসলিম সমাজ দিন দিন অধ:গতির দিকে সবেগে ধাবিত হচ্ছে। আমাদের চারপাশে কুফর, শিরক ও বিদয়াত পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ছে। শায়খুল হাদীস আল্লামা মুহিব্বুল হক কুরআনের আলোকে ও মুসলমানের জিন্দেগী গড়ে তোলার জন্য আমৃত্যু ঈমান ও আমলের দাওয়াত দিয়ে গেছেন। তাঁর প্রজ্ঞা ও জ্ঞান তাকে সমাজে উচ্চাসনে উপণীত করেছে। তাঁর কর্মই তাকে দিয়েছে সুউচ্চ সম্মান। তাঁর চারিত্রিক গুণাবলী চরমোৎকর্ষ লাভ করেছে সর্বমহলে। তিনি নিজ কামালিয়াতের দ্বারা বুলন্দ মোরতবায় পৌঁছেছিলেন। প্রতি মাহফিল/মজলিসে তিনি হৃদয়ের স্বর্গীয় আবেগ নিয়ে উচ্চারণ করতেন পবিত্র কুরআনের শাশ্বত বাণী। মানুষের জীবনে সত্য ও সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত হউক এটাই ছিল হুজুরের একমাত্র সাধনা। তিনি ঈমান দীপ্ত আশাবাদ অন্তরে জাগ্রত রাখতে মানুষকে নসিয়ত দিতেন। কুরআনের ঐশ্বরিক বাণী- সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অর্থাৎ ইসলাম আল্লাহতায়ালার মনোনীত ‘দ্বীন’ বা জীবনব্যবস্থা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ কিভাবে জীবনযাপন করবে ইহাতে তাহার নির্দেশ রয়েছে অন্যকথায় বলা যায়, মানুষ যে সমস্ত উপায় অবলম্বনে মহান আল্লাহকে জানতে ও চিনতে পারে তাঁকেই ইসলাম বলে। আর ইসলামে যারা বিশ্বাসী এবং অনুসারী তাদেরকে বলা হয় মুসলিম। গাছবাড়ি হুজুর নবী ও রাসূলের তরিকায় কুরআনের বিধি নিষেধ অনুযায়ী স্বীয় জীবন পরিচালনার জন্য ওয়াজ করে গেছেন। তিনি সহজভাবে কুরআনের আলোকে ইসলামের ব্যাখ্যা ও যুক্তি প্রদর্শন করতেন। তিনি এ কথাই বলতেন একমাত্র দ্বীনই ইলম্ এর বিস্তার দ্বারাই অবক্ষয়িত দ্বীনি জ্ঞানশূন্য মানুষের চক্ষু উম্মীলন ঘটবে।
আল্লামা মুফতি মুহিব্বুল হক গাছবাড়ি (র.) ছিলেন সত্য কথনে নির্ভয় ও আপোসহীন। তিনি নৈতিকতার প্রশ্নে আপোসহীন মানুষ ছিলেন। তিনি ইসলামী শিক্ষার বিস্তৃতি ও বিস্তারে আমরণ খেদমত করে গেছেন। ইসলামের সুন্দরতম আদর্শ বিধিবিধানগুলো মানবজাতির কাছে পৌঁছে দেয়ার শক্তিশালী মাধ্যম হলো দ্বীনি শিক্ষা। ইসলামের সৌন্দর্য আত্মভোলা মানুষের কাছে তুলে ধরতে এবং দ্বীনের পথে চলার জন্য একনিষ্ঠভাবে দ্বীনের খেদমত করে গেছেন। তিনি প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজের আগে বয়ান করতেন তা বিদগ্ধ নামাজীকে আল্লাহ প্রেমে উদ্ভাসিত করত, গাছবাড়ি হুজুর ইলমে দ্বীনের প্রচারে আত্মভোলা মানুষ হেদায়াতের জ্যোতিতে মহিমান্বিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন এ যুগের ‘ইলমে জামান’। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন কুরআন শরীফের একটি আয়াত শিক্ষা করা বা শিক্ষা দেয়া একশত রাকাত নফল নামাজ পড়া থেকে বেশি নেকী হয়, পক্ষান্তরে দ্বীনের একটি মাসয়ালাহ শিক্ষা করা বা শিক্ষা দেয়া হাজার রাকাত নফল নামাজ পড়া থেকে বেশি নেকী বা সওয়াব। হুজুর যখন নসিয়ত করতেন তখন পিন পতন নীরবতায় কুরআনের ঐশ্বরিক বাণীর মর্মার্থ হৃদয়ে আলোড়িত হতো। গাছবাড়ি হুজুর আপন মহিমায় সমুজ্জল হয়ে সকলের কাছে শ্রদ্ধা ও গৌরবের পাত্র ছিলেন। তাঁর সাহচর্যে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে বলতে চাই মাওলানা সাহেবের সংস্পর্শে এসে অনেকেই পুণ্যের পরশে পুণ্যবানে পরিণত হয়েছেন। আমি তাঁর ভালোবাসায় প্রাণীত হয়েছি। গাছবাড়ি হুজুরের জীবন থেকে শিক্ষা হলো সম্মানিত হতে হলে অহঙ্কারকে পরিত্যাগ করতে হবে। মাওলানা সাহেবের মুখের নিঃসৃত বাণী ঝিনুকের মুক্তার মতো দামী ছিল। তিনি সর্বদা বিনয়ী ও সজ্জন ছিলেন। জাতীয় জীবনে অন্যায় অবিচার ও দুর্যোগে তিনি মানবতার কল্যাণে সদাজাগ্রত ছিলেন। সর্বোপরি তিনি ছিলেন বিবেকী কণ্ঠ ও অনৈসলামিক কর্মকা-ের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর।
ক্বাওম অর্থ জাতি। ক্বাওমী মাদ্রাসার অর্থ হলো জাতীয় বিদ্যাপীঠ। ক্বাওমী মাদ্রাসা বলতে ঐ সকল মাদ্রাসাকে বুঝায় যেখানে ইসলামী আক্বিদা, বিশ্বাস, তজবীদ, তমুদ্দুনের সংরক্ষণ বিকাশের প্রয়োজন এ ধরনের দ্বীনি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ি (রহ.) ছিলেন সম্মিলিত ক্বাওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এর অতি হায়াতুল উলয়ার সদস্য ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্য। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমীর সিলেট জেলা সভাপতি, সিলেটের শিক্ষাবোর্ড আযাদ দ্বীনি এদারার সিনিয়র সহ সভাপতি ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, খাদিমুল কুরআন পরিষদের সভাপতি, সিলেট জেলা উলামা কমিটির চেয়ারম্যান ও সিলেট জেলা ফতোয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান। তাছাড়া হযরত শাহপরাণ উপশহর জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও মোতাওয়াল্লি ছিলেন।
আল্লামা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ি ১৯৪৫ সনের ০৬ ডিসেম্বর কানাইঘাট উপজেলার ঝিঙ্গাবাড়ি ইউনিয়নের ফকরচটি গ্রামে পিতা মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক (রহ.) ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর তিনি মাযাহিরুল উলুম আকুনি মাদ্রাসায় সানারিয়া ৩য় বর্ষ পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। পরে জালালাইন ও মিশকাত জামাত জামিয়া দারুল উলুম কানাইঘাটে লেখাপড়া করেন। অত:পর তিনি ঐতিহ্যবাহী জামেয়া হুসাইনিয়া আরাবিয়া রানাপিং-এ মাওলানা রিয়াসত আলী চৌধুরী (রা.) এবং মাওলানা তাহের আলী তৈপুরী (রা.) নিকট দাওরায়ে হাদীস পড়েন। তিনি দারুল উলুম মইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে ১৯৬২ সালে তাকমীল ফিল হামিদ সম্পন্ন করেন এবং সেই সাথে হাটহাজারীতে ফেক্বাহ তাফসীর আদব ও মানকিন শাস্ত্রীয় বিষয়ে উচ্চতর পড়াশুনা করেন।
হযরত আল্লামা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ি বুধবার ১৭ মে ২৬ শাওয়াল ১৪৪৪ হিজরি দিনভর দ্বীনের খেদমতে নিজেকে ব্যস্ত রেখে অপরাহ্নে কর্মস্থল মাদ্রাসায় অবস্থান নেন। তিনি মাগরিবের নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে হযরত আযরাঈল ফেরেস্তা (মালাকুত মউত) মৃত্যুর অধিপতি রূহ কবজ করে মহান রবের সান্নিধ্যে নিয়ে যান। (ইন্নালিল্লাহি… রাজিউন)। মৃত্যুকালে স্ত্রী, তিন পুত্র ও চার কন্যাসহ হাজারও ছাত্র-শিক্ষক ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, গুগল ও ম্যাসেঞ্জারে আবেগ সম্মিলিত হাজার হাজার পোস্টে হুজুরের মৃত্যু সংবাদ আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। মৃত্যু জীবনের সূর্যের আলোর চেয়েও বড় সত্য। মৃত্যু মানে অনন্তকালের জন্য অনন্ত শূন্যতায় মিলিয়ে যাওয়া। তিনিই জীবন দেন এবং মৃত্যু ঘটান এবং তারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে (সূরা ইউনুস আয়াত ৫৬) মানুষ অনন্ত সফরের যাত্রী। প্রকৃতই মানুষ দুনিয়াতে মুসাফির বা পথিক। সত্য অনুধাবনের জন্য দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী জীবন। এই মহান বুজুর্গের নামাজে জানাজায় ছিল গভীর অনুরাগ আর শ্রদ্ধায় লাখো মানুষের ঢল ঐতিহাসিক শাহী ঈদগাহ ময়দানে। ময়দানে দাঁড়িয়ে আমার মনে হযরত হাসান বসরী (রহ.) উপদেশ মনে পড়ল- মৃত্যুর পর তোমাকে মানুষ কিভাবে মূল্যায়ন করবে তা তোমার চোখের সামনে যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের পরিণতির মধ্যেই দেখতে পাবে। তাদের কাকে কিভাবে মানুষ স্মরণ করছে তা লক্ষ কর এবং বিশ্বাস কর যে, তোমাকেও অনুরূপভাবেই স্মরণ করবে। এ প্রসঙ্গে হাদীসে আছে ‘আদ দুনিয়াই মাজরাতুল আখেরা’ অর্থাৎ দুনিয়া আখেরাতের ক্ষেত্র স্বরূপ।
এই অজেয় সিপাহসালার হযরত শাহজালাল (রহ.) গোরস্থানের উত্তর প্রান্তে অনুচ্চটিলায় দেওয়াল ঘেঁষে তাঁরই প্রতিষ্ঠান জামেয়া ক্বাসিমুল উলুম মাদ্রাসার অনুমানিক ২৫/৩০ গজ দক্ষিণে মাদ্রাসার উত্তরসূরি হযরত আবুল কালাম জাকারিয়া (রহ.) সমাধির সন্নিকটে গাছবাড়ি হুজুর চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
আমি তন্ময় হয়ে ভাবি আত্মা কি? খাঁচার ভিতর অচীন পাখি কেমনে আসে যায়।’ এ কোন অচীন পাখি যার আগমনে মানবদেহ স্পন্দিত হয়- আর সে উড়ে গেলে জীবনের ঝরণা শুকিয়ে যায় একেবারে। আমার মনে শেখ ফরিদের চরণ মনে পড়ল- ফরিদ ধূলিকে করো না ঘৃণা/ তার মতো আর কিছু নেই/ যখন জীবিত থাকি ধূলি থাকে পায়ের নিচে/ মৃত হলে ধূলি থাকে আমাদের পরে।
লেখক : কলামিস্ট।