অতি ধনী ও অতি দরিদ্র শ্রেণি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ মে ২০২৩, ২:১৫:৪০ অপরাহ্ন
মো. আব্দুল ওদুদ
বিশ্ব ব্যাংকের দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশিদার ২০১৮ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাঁচটি দেশেই বিশ্বের অর্ধেক গরিব লোক বাস করে। এই দেশগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ। বাকি দেশগুলো ভারত, নাইজেরিয়া, কঙ্গো ও ইথিওপিয়া। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এদেশে অনেকটাই গরীব পোষার রাজনীতি চলেছে। অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা ও উপযুক্ত শিক্ষার অভাব থাকায়, ব্যবসায়ীরা এই বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে বাণিজ্য করছেন। খেটে খাওয়া মানুষের যথাযথ পারিশ্রমিক না দিয়েই ‘অতি ধনী’ অথবা রাষ্ট্রের তহবিল তছরূফ করে বিশ্বে ধনকুবের বৃদ্ধির উত্থানে শীর্ষে আমরা।
গরীব মানুষদের নিয়ে রাজনীতি করা অনেক সহজ। রাজনৈতিক কম টাকায় সাধারণ মানুষকে ভাড়া করা যায়। আবার বেশ সংখ্যক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা খুব সহজেই এদের রক্ত চুষে খান। গরিবের সব রকম অধিকার হরণ করা যায়। কারণ গরিবরা নিজেদের পেটের চাহিদা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তারা অধিকার আন্দোলন খুব কমই বুঝে। এখনও মানুষ অভাব অনটনে জর্জরিত হয়ে ভিটে মাটি বিক্রি করে পরিবারের মায়া ত্যাগ করে একটু সচ্ছলতার আশায় নিজের জীবনকে বাজি রেখে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এখনো যে দেশের অনেক মানুষ তিন বেলা পেট ভরে খেতে পায় না। ডিগ্রি মাস্টার্স পাস হওয়া বা ফেরিওয়ালা বেশুমার। না খেয়ে, ক্ষুধার্ত থেকে কেউই সুন্দর দেশ চাইতে পারে না। আগে মানুষ খেতে চায়, পরতে চায়, নিরাপত্তা চায়। কার আসলে মানব উন্নয়নসূচক বা বেড়েছে তা সাধারণ মানুষের দেখার বিষয় নয়। কে কত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করল তাও সাধারণের জেনে লাভ নেই। তবুও বলতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে গত ১০ বছরে দেশ থেকে ১০ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। অন্য তথ্য থেকে পাওয়া ১১ বৎসরে ১৯ লাখ কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়েছে। ২ বৎসরে ১২ হাজার কোটিপতি বেড়েছে। অন্যদিকে প্রায় ৩ কোটি মানুষ আর গরীব হয়েছে। তথাপি গরিব মানুষ ভিজে সারা দিন খেটে দুই মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে আর নিজের পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়।
২০২২ সালের ২ মে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর এ্যাডভান্সড ডিফেন্ড স্টাডিজ (সি৪এডিএস) এক প্রতিবেদনে বলেছে, তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে সম্পদ কিনেছেন ৪৫৯ জন বাংলাদেশি। ইইউ ট্যাক্স অবজার ডেটরি সূত্র ধরে তারা বলছে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশিদের মালিকানায় সেখানে ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। কাগজে-কলমে যার মূল্য ৩১ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। তবে প্রকৃত পক্ষে এসব সম্পত্তি কিনতে বাংলাদেশি ক্রেতাদের ব্যয়ের পরিমাণ আর অনেক বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য এখন পর্যন্ত কাউকে আরব আমিরাতে বৈধ পথে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়নি।
এসব সম্পদের মধ্যে ৬৪টি দুবাইয়ের অভিযাত এলাকা দুবাই মেরিনা ও ১৯টি পাস জুমেইরাতে অবস্থিত। সেখানে অন্তত ১০০ ভিলা ও কমপক্ষে ৫টি ভবনের মালিক বাংলাদেশি বলে জানা গেছে। চার থেকে পাঁচ জন বাংলাদেশি ৪৪ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির মালিক। যদিও প্রতিবেদনে কারও পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। প্রতিবেদন অনুযায়ী আর্থিকখাত এবং রিয়েল এস্টেট পাচারকৃত অর্থের প্রধান খাত। দুবাইয়ে যেসব বাংলাদেশি সম্পত্তির মালিক তাদের মধ্যে ৩৩২ জন পুরুষ। দুবাইয়ের বাংলাদেশি রিয়েলএস্টেট মালিকদের মধ্যে ৩১৮ জনের বয়স ৩৪ বৎসরের কম এবং ৯৭ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি।
সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ গোল্ডেন ভিসা সুবিধা চালু করার পর বাংলাদেশিদের দুবাইয়ে প্রপার্টি ক্রয়ের মাত্রা হু হু করে বাড়ছে। বিত্তবান বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে ২০১৯ সালে গোল্ডেন ভিসা চালু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সম্পত্তির মালিকানা থাকলেই এ ভিসার জন্য আবেদন করা যায়। শর্ত সহজীকরণের পাশাপাশি ভিসা প্রক্রিয়ার জটিলতাগুলোও দূর করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ধনীদের অনেকেই ইউএইর দেওয়া এ সুযোগ লুফে নিয়েছেন। দেশের ব্যাংক পরিচালক, রাজনীতিবিদ, পোশাক ব্যবসায়ী, সড়কের বড় বড় ঠিকাদার সহ দেশের বড় ও মাঝারি অনেক পুঁজিবাদরাই এখন আমিরাতের গোল্ডেন ভিসাধারী। তাদের মাধ্যমেই দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে থাকতে পারে।
দুবাইয়ে তিন-চার কক্ষের ফ্ল্যাট কিনতে খরচ হয় তিন থেকে চার লক্ষ দিরহাম যা বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকার সমান। অর্থাৎ রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোর চেয়ে দুবাইয়ে ফ্ল্যাটের মূল্য কম।
২০২২ সালে ২ মে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সি৪এডিএস) এক প্রতিবেদনে অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকার এমন সম্পদের তথ্য ওঠার পর এক পর্যায়ে নজরে আসে দেশের উচ্চ আদালতের। আদালত তদন্ত করে তাদের নাম, পরিচয় ও অর্থ পাঠানোর মাধ্যমগুলো জানতে আদেশ দেন চারটি তদন্তকারী সংস্থাকে। হাইকোর্টের এই আদেশ তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।
সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শ্রম বাজার সঠিক পথে নেই। শ্রম বাজারে অনানুষ্ঠানিক খাতের বিস্তার ঘটছে। বেকারত্বের হার বেড়েছে। বেকারত্বের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্য আছে সরকারের। এদেশের মানুষের আয় বাড়ছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
যে দেশে গরিব থাকে; যে দেশে গরিবের বসবাস। চার পাশে তাকালেই বুঝা যায়, আমাদের দেশে কত গরীব লোক বাস করে। তারা চায় দরিদ্রতা থেকে মুক্তি। তাহলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শ্রমের মূল্য বাড়াতে হবে। বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথওক্স বলেছে অতি ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ প্রথম। সম্প্রতি একই প্রতিষ্ঠান আরেকটি প্রতিবেদনে বলেছে, ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ তৃতীয়। আগামীতে বাংলাদেশে ধনী মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে। যে পাঁচটি দেশে বিশ্বের অর্ধেক গরীব লোক বাস করে। বিশ্ব ব্যাংক ওই পাঁচটি দেশে কত গরীব লোক বাস করে সেই হিসাবও দিয়েছে। সেই হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ১ কোটি ৬২ লাখ মানুষের দৈনিক আয় ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম, অর্থাৎ ১৬০ টাকার নীচে। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা অনুযায়ী, এরা গরীব।
দেশে অতি ধনীর সম্পদ বাড়ছে। এর একটা ভাল দিক হলো, দেশের সম্পদ বাড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে সম্পদ কী তারা সঠিক পথে আয় করেছেন। তার ন্যায্য আয়কর কী তারা দেন, নাকি সে টাকা বিদেশে পাচার করে দেন। বুঝতে হবে ১০ থেকে ২০ হাজার ধনীর সম্পদ বাড়লে দেশের লাভ নেই। তার চেয়ে শিক্ষিত বেকার মানুষের বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া জরুরি। সেই দিকটা খুবই অবহেলিত। বর্তমানে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী শিক্ষিত অধিকাংশ তরুণ-তরুণী রয়েছেন যারা কোন কাজ করেন না, আবার পড়াশোনাও করছেন না। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি। এটা দেশের জন্য বড় একটি সমস্যা। যা বড়ই উদ্বেগের বিষয়। এমন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পাশাপাশি কাজ ও পড়াশোনা কোনোটিই করেন না, এমন তরুণ-তরুণীর বেকারত্ব দূর করার জন্য বেসরকারী খাতের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।
তরুণ-তরুণীদের মধ্যে উৎপাদনশীল খাতে কাজের সৃষ্টি করতে হবে। বড় ডিগ্রির সার্টিফিকেটের চেয়ে দক্ষতা ভিত্তিক ছোট সার্টিফিকেটের ডিমান্ড বেশি। এই কারণেই হাজার হাজার উচ্চ সার্টিফিকেটধারী বেকার। লেখাপড়া করে ফেলেছি, এখন আমার বড় অফিসার হতেই হবে, এ মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। আধুনিক কৃষি, পশুপালন, মৎস্য খামারের উদ্যোক্তা হওয়ার মনমানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। নব উদ্যোক্তাদের জন্য বাধা ও সমস্যার কারণও রয়েছে। এলাকায় গিয়ে কিছু করতে গেলেই, এদের বিরুদ্ধে কুৎসায় লিপ্ত হয় তথাকথিত কিছু মুরুব্বি প্রতিবেশি। এ জন্য সমাজের কিছু মানুষগুলো অনেকাংশে দায়ী। প্রথমে আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে, নিজে নিজে চলা শিখতে হবে। দেশে কোন মানবসম্পদ পলিসি নেই। এদেশে যে যার মতো পড়ালেখা করছেন। কিন্তু পড়ালেখা শেষে তিনি কী করবেন তার কোনো ধারণাই রাখা হয় না। শেষে শিক্ষা জীবন শেষে বেকারত্ব। অথচ এমন বহুখাত আছে যেখানে দক্ষ জনবলের অভাব প্রকট।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রভাটি এ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা বিশ্বে এখন দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম আয় করেন এমন দরিদ্র লোকের সংখ্যা ৭৩ কোটি ৬০ লাখ। তারা হতদরিদ্র হিসেবে বিবেচিত। এর মধ্যে উল্লেখিত পাঁচটি দেশেই বাস করে ৩৬ কোটি ৮০ লাখ গরিব লোক। এটা আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্ব ব্যাংক ওই পাঁচটি দেশে কত গরীব লোক বাস করে সে হিসাবও দিয়েছে। সেই হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ১ কোটি ৬২ লাখ মানুষের দৈনিক আয় ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা অনুযায়ী এরা গরীব। এছাড়া ভারতে ৯ কোটি ৬৬ লাখ, নাইজেরিয়ায় ৯ কোটি ৯২ লাখ, কঙ্গোয় ৬ কোটি ৭ লাখ এবং ইথিওপিয়ায় ২ কোটি ১৯ লাখ গরিব মানুষ বাস করে।
স্বল্পোন্নত দেশের কাতার উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়া জাতির জন্য বিরাট অর্জন। বড় অর্জনে চ্যালেঞ্জও অনেক বেশি। সেই দিক থেকে কিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে দেশকে। তাই সরকারকে দেশের সবাই সহযোগিতা করতে হবে। দেশ এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এখনো বাংলাদেশের বাজেটে আয় হিসেবে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক ঋণের কথা উল্লেখ করতে হয়। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে তা থেকে বাংলাদেশ সুফল পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। যে দেশে দুর্নীতি কোথায় আছে না বলে, দুর্নীতি কোথায় হয় না বলতে হবে। দুর্নীতি স্বমূলে দূর করতে না পারলে রাষ্ট্র ও দৈন্যদশাগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে।
এমন লাখো লাখো মানুষ রয়েছে যাদের দৈনিক রুজি দিয়ে এবং মাসিক বেতন দিয়ে ২০ দিনও সংসার চালাতে কষ্ট হয়। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশের লোকজন কাজ করে অর্থ উপার্জন না করলে দেশের অনেক পরিবার না খেয়ে থাকতো। বেশ কিছু মানুষ বিভিন্ন বেআইনি পথে অসৎ উপায় অবলম্বন করে প্রচুর টাকা ও সম্পদের মালিক হয়েছেন। এই সমস্ত টাকা ও সম্পদের মালিকরাই সরকারের আয়কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করছেন। রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের আমলে সারাদেশে অবশ্যই ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। পাশাপাশি কিছু অসাধু লোক সম্পদের পাহাড় গড়েছে। আর গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে। এহেন অবস্থা মেনে নেওয়া যায় না। তাই সরকারকে এ ব্যাপারে আরও বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গরিবি হটাতে হবে।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, কলামিস্ট।