ছয়দফা : ইতিহাসের মোড় ঘুরানো কর্মসূচি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ জুন ২০২৩, ৫:২২:২৮ অপরাহ্ন
শেখর ভট্টাচার্য
ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়টা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিলো। এই শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ব্রিটিশরাজ বা রাণী ভিক্টোরিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৮৭৬ সালে সমগ্র অঞ্চলটিকে সরকারিভাবে ভারতীয় সাম্রাজ্য নামে অভিহিত করা হয় এবং এই নামেই পাসপোর্ট ইস্যু করা হতে থাকে। ১৮৫৮ সাল থেকে ১৯৪৭ অর্থাৎ প্রায় ১৮৯ বছর ভারতীয় সাম্রাজ্য ব্রিটিশ রাজের অধীন ছিলো। ব্রিটিশ শাসন কায়েম করা হয়েছিলো সম্ভাবনাময় এই অঞ্চলটিতে বাণিজ্যের নামে ঔপনিবেশিক শোষনকে অব্যাহত রাখার অভিপ্রায় নিয়ে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন অঞ্চলকে স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের নানামুখী সংগ্রামের মুখে বিভাজন করা হয়। এই বিভাজন সম্পন্ন হলো ব্রিটিশ ভারতকে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র- ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত করার মাধ্যম। ভারত অধিরাজ্য বর্তমান সময়ে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র; পাকিস্তান অধিরাজ্য বর্তমান সময়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসাবে পরিচিত। যে ভূখন্ড নিয়ে আজকের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, সে অঞ্চলটি ৪৭ সালে এক মিথ্যা বা অলীক স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসাবে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীরা একই ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার ছিলো। পাকিস্তান সৃষ্টির হাজার বছর পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ বাংলাভাষী বাঙালি হিসাবে পরিচিত ছিলো। পাকিস্তান সৃষ্টির পর যখন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো যে এই স্বাধীনতা তাদের স্বপ্নের স্বাধীনতা নয়, তাঁদেরকে নানা ভাবে ধোঁকা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশের অধিবাসী তৈরি করা হয়েছে তখন থেকেই তেরোশত নদীতে ঘেরা এই সুবর্ণ পলির মানুষেরা পাকিস্তান কাঠামো থেকে মুক্তি পেতে আবারও বিরামহীন আন্দোলনে নেমে পড়ে।
আন্দোলন শুরু হয় ভাষা সংস্কৃতির অধিকারকে কেন্দ্র করে।ভাষা সংস্কৃতির অধিকার আন্দোলন করতে গিয়ে বাঙালি নিজেদেরকে পুনরাবিষ্কার করার অপার সুযোগ পায়। বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য তাদেরকে নুতন করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই যে জাতি হিসাবে চক্ষু উন্মীলন, তাকে অনেক বাঙালি গবেষক ‘বাঙালির স্বদেশ প্রত্যবর্তন’ নামে অভিহিত করেছেন। পাকিস্তান আন্দোলন এবং এর অব্যবহিত পরে মানসিক ভাবে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বিরাট অংশ নিজেদের ঐতিহ্য, ইতিহাস মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রোপিত আছে বলে মনে করতো। ভাষা আন্দোলন সেই ভাবনার ঘরে একটি বিরাট ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়। বাঙালির মানস জগতে এক বিরাট পরিবর্তন সাধন হুয়। এই পরিবর্তন, এই জেগে ওঠাকে বেশির ভাগ বাঙালি দার্শনিক সীমিত আকারে বাঙালির রেনেসাঁস হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
বায়ান্নতে সংঘটিত এই সীমিত রেনেসাঁস বা পুনর্জাগরণ ভাষা সংস্কৃতি কেন্দ্রিক হলেও, এই আন্দোলন ক্রমান্বয়ে স্বাধিকার আন্দোলনের রূপ পায়। বাঙালির ‘প্রমিথিউস’ যিনি এই স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তখনও তিনি শেখ মুজিব, মুজিব ভাই, শেখ সাহেব। বাঙালির হৃদয়ের গহীনের সংবাদ তাঁর থেকে বেশি কেউ কোনদিন রাখতে পারেনি। বায়ান্ন থেকে ধাপে ধাপে তিনি সকল শ্রেণির মানুষকে নিয়ে সর্বোচ্চ নিবেদন দিয়ে বাঙালির অধিকার আন্দোলনকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দূরদর্শী নেতা হিসাবে সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। চুয়ান্ন’র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে শাসক মুসলিমলীগের প্রতি মানুষের অনাস্থা, আটান্নতে সামরিক শাসন ও আইয়ূব খানের ক্ষমতা দখল। সব মিলিয়ে সারা পূর্ব বাংলায় সামরিক শাসনের যাঁতাকলে উৎপীড়ন, নিপীড়ন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। আইয়ূব খান ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে জোড়াতালি দেয়া এক মেকী গণতন্ত্র চালু করলেন এবং এর নাম দিলেন মৌলিক গণতন্ত্র। বাঙালির সেই দুঃসময়ে রাজনীতির কবি, বাঙালির প্রাণের নেতা শেখমুজিব জেল জুলুম, হুলিয়া মাথায় নিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে মিলে মিশে প্রতিরোধ আন্দোলনকে তীব্র করে তুললেন।
আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে সে সময় অর্থাৎ ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলগুলোর এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। শেখমুজিব ভাবলেন সমগ্র পাকিস্তানের নাড়ির স্পন্দন অনুভবের জন্য এখানেই বাঙালির প্রানের দাবিকে তুলে ধরতে হবে। কনভেনশনে ছয়দফাকে বিষয়সূচির অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জানান। এখান থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় বাঙালির স্বাধিকারের যৌক্তিক আন্দোলনে প্রতিক্রিয়াশীল এবং ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়তা পাওয়া যাবেনা কোন অবস্থাতেই।
ছয়দফার প্রতিটি দফা বিশ্লেষণ করলে বাঙালির এই মুক্তি সনদের অন্তর্নিহিত বাণী খুঁজে পাওয়া যায়। ছয় দফা যদিও সচেতন পাঠকদের কাছে অজানা নয় তারপরও স্বাধীনতাত্তোর প্রজন্মের উপলব্ধির জন্য তুলে ধরার তাগিদ অনুভব করছি। প্রিয় পাঠক দফা গুলোর দিকে একটু দৃষ্টি নিক্ষেপ করি আমরা :
১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে।
২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে।
৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকবে।
৪. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোন হারে আদায় করা হবে।
৫. দুই অংশের মধ্যে দেশীয় পণ্য বিনিময়ে কোন শুল্ক ধার্য করা হবে না এবং রাজ্যগুলো যাতে যেকোন বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।
৬. প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।
বাংলার সর্বস্তরের জনগণের মাঝে ৬ দফা ব্যাপক সমর্থন পায়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ১৯৬৬ সালে ৮ মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের এক সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার পর বাঙালির প্রাণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী। তাকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের কারণে জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
৭ জুন আওয়ামী লীগ শেখমুজিব ও অন্যান্য নেতার মুক্তির দাবিতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন তথা বাঙালি জাতির মুক্তির ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে পূর্ণ দিবস হরতাল আহবান করে। অভূতপূর্বভাবে সে হরতাল সাড়া দেয় ছাত্র-শ্রমিক-জনতাসহ সারা দেশের মানুষ। হরতাল বানচাল করতে পুলিশ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে মুক্তিকামী মানুষের মিছিলে গুলি চালায়। এতে ঢাকার তেজগাঁওয়ে শ্রমিক নেতা মনু মিয়া, ওয়াজিউল্লাহসহ ১১ জন এবং নারায়ণগঞ্জে সফিক ও শামসুল হক নিহত হন। আহত হন অনেকেই।
সরকারের বিরূপ প্রচারণা ও অত্যাচারে ৬ দফা আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ৬ দফা যখন জনগণের ব্যাপক সমর্থন পায় ঠিক সেই সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখমুজিবকে অভিযুক্ত করে এক নম্বর আসামি করা হয়। স্বৈরাচারী শাসকেরা ভেবেছিল মামলা দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন নিঃশেষ করে দেয়া সম্ভব। কিন্তু হলো তার বিপরীত। আগরতলা মামলা দায়েরের পর তিনি পরিণত হন মহানায়কে।
অনেকেই মনে করেন স্বাধীনতার জন্য বাঙালির এই জেগে ওঠা বোধ হয় হঠাৎ আলোর ঝলকানি । বিষয়টি মোটেই তা’ নয়। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফলাফল। এ প্রক্রিয়াটিকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাই তিনি ভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে স্বায়ত্ব শাসনের আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যান। স্বপ্নটি তার কাছে স্বচ্ছ্ব ছিলো। স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন মূর্ত হয়ে উঠেছিলো ছয়দফা দাবির মধ্য দিয়ে। ছয় দফাকে পাকিস্তানিরা উপেক্ষা করতে পারেনি আবার গ্রহণ ও করতে পারছিলোনা। ছয়দফা ছিলো কফিনের শেষ পেরেক । ছয়দফা পেশের পর পাকিস্তানি শাসকেরা মরিয়া হয়ে উঠেছিলো শেখ মুজিব ও বাঙালি জাতিসত্তাকে গুড়িয়ে দেয়ার জন্য। ছয়দফা দমনের জন্যই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সুচনা হয়। আর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মোকাবেলায় পাকিস্তানি শাসকেরা যতো নিষ্ঠুরতা অবলম্বল করেছিলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা তত দ্রুত বাঙালিদের কাছে দৃশ্যমান হওয়া শুরু করে। ছয়দফার পরিণতিতে ঘটে গণঅভ্যুত্থান এবং এই গণঅভ্যুত্থান জাতিকে প্রস্তুত করে স্বাধীনতার আন্দোলনে। ছয় দফা তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ যাকে “গ্যামচেঞ্জার” বা ইতিহাসের মোড় ঘুরানো কর্মসূচি হিসাবে অভিহিত করা যায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক।