আম্বল
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জুন ২০২৩, ১২:৪০:৪৬ অপরাহ্ন
মাসুম মাহমুদ
বোঝাই যাচ্ছে না ঘন সবুজ পাতাগুলোর ফাঁকে একটুখানি ওটা কী? একবার মনে হচ্ছে খড়কুটো দিয়ে তৈরি কাকের বাসা, ফের মনে হয় শুকিয়ে যাওয়া একটা হলুদ পাতার শরীর। অনেকক্ষণ ভেবেও নিতু ঠাওর করতে পারে না আসলে কী?
হঠাৎ সামান্য হাওয়া এসে পাতাগুলো নাড়িয়ে দিতেই দেখে মনে হলো ওটা একটা পাকা আম। অমনি ‘আম পেকেছে, আম পেকেছে’ বলে বলে নিতুর সে কি আনন্দ! এখনি বুঝি দমকা হাওয়া এসে আমটা মাটিতে ফেলবে আর মুঠোয় লুফে নেবে সে। ওদিকে নিতুর মা ঘরের জানালায় বসে ডাকছে, ‘চলে আয়, নিতু। একটা আমের জন্য কষ্ট করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। ঘরে পাকা আম আছে।’
মায়ের সাথে নিতুর ছোট ভাই নিনাদও বসা। ওরা দুই ভাই বোনের অনেক ভাব। একসঙ্গে গল্পের বই পড়ে, কেরাম খেলে, টিভি দেখে আবার বাড়ির উঠোনে ক্রিকেটও খেলে। আজ সকালে খেলতে গিয়ে নিনাদের বলটা হারিয়ে গেছে। তখন থেকে ওর খুব মন খারাপ। নিতু অনেকবার করে বলেছে, ‘চল তোকে এক্ষুণি একটা বল কিনে দিই।’ না, নিনাদ কোথাও যাবে না। সারাদিন কারো সাথে কথাও বলেনি। চুপচাপ ঘরে বসে ছিল। এই এখন মায়ের সাথে সাথে সেও বোনকে ডাকে, ‘চলে আসো, আপু। ঘরে পাকা আম আছে।’
ঘরে পাকা আম আছে নিতু জানে। ওগুলো বাজার থেকে কেনা আম। নিতুর চাই গাছপড়া। গাছ থেকে উড়ে এসে ওর হাতে পড়বে। এরকম আমই চাই। কিন্তু পড়ছেই না! আর কতক্ষণ অপেক্ষা করা লাগবে কে জানে! উপরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড় ধরে আসছে নিতুর! বিড়বিড় করে বলে, ‘ও আম! তুমি কত্তো ভালো, তাড়াতাড়ি পড়ো না প্লিজ।’
নিতু চোখ ভরে দেখে পাতাদের ফাঁকে ফাঁকে দু’তিনটে পাখি ফুড়ুৎ ফাড়ুৎ উড়ে যাচ্ছে। সবই হচ্ছে, শুধু আমটাই পড়ছে না। কখন পড়বে অপেক্ষা করতে করতে এবার রাগ হচ্ছে নিতুর।
উহু! আমটা খুব পাজি। এতো সহজে পড়বে না। নিতু ডাকলো বলে উল্টো সে পাতার আরো আড়ালে চলে গেল! এখন আর দেখাই যাচ্ছে না, তাহলে কী হবে! নিতু মনে মনে ভাবে। ওদিকে মা ফের বলছে, ‘বাইরে একটুও হাওয়া নেই। হাওয়া না থাকলে আম কেমন করে পড়বে শুনি! গাছে কি ভূত আছে যে ভূত গাছ ঝাড়া দিবে আর ধুপধাপ করে আম পড়বে!’
নিতু ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখন হাওয়া নেই, কিন্তু একটু পরই হাওয়া চলে আসবে; তখন ধপাস করে পড়ে যাবে।’
‘হ্যাঁ! বলেছে তোকে হাওয়া চলে আসবে। বলছি শোন, ফ্রিজে দু’খানা আম আছে, আজ ভোররাতের ঝড়ে ঝরে পড়েছিল। একেবারে টসটসে পাকা। মাটিতে পড়ে সামান্য ফেটে গেছে।
তোর তো গাছপড়া আমই চাই, চলে আয় ফ্রিজ থেকে বের করে দিচ্ছি।’
‘মা! ফ্রিজের আম আর গাছ থেকে পড়া টাটকা আম; দুটো এক হলো?’
এমন সময় নিতুর বাবা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বলল, ‘একদমই এক নয়। মাত্রই নদী থেকে তুলে আনা মাছ আর দু’দিনের বরফ দেওয়া মাছের স্বাদ তো এক হয় না। নিতুর ওই আমটাই চাই। এক্ষুণি জাল ফেলে তুলে আনা তরতর করে লাফানো মাছের মতো তাজা আম। নিতু মা তুমি দাঁড়িয়ে থাকো, ওই আমটা নিয়েই ঘরে ফিরবে।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ, বাবা’, এই বলে নিতু টের পাচ্ছে ওর শরীরে একটু ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে। বুঝাই যাচ্ছে হাওয়া ছাড়বে। আর টসটসে গাছপাকা আমটা ঠাস করে নিচে পড়বে। নিতু এবার হাত দুটি উপরে তুলে স্থির তাকিয়ে থাকে। আমটা পড়বে আর ক্রিকেটারের মতো ক্যাচ ধরে ফেলবে।
ভাবতে ভাবতে হাওয়া বইতে শুরু করে। হাওয়ায় হাওয়ায় এক ডালের পাতা আরেক ডালের পাতাকে ছোঁ মেরে ছুঁতে চাইছে। যেন ছোঁ নৃত্যে মেতে উঠেছে পাতাগুলো বাতাসের বাঁশি, ঢোল, পাখোয়াজের সঙ্গীতায়োজনে। নিতু চোখ ভরে দেখে পাতাদের ফাঁকে ফাঁকে দু’তিনটে পাখি ফুড়ুৎ ফাড়ুৎ উড়ে যাচ্ছে। সবই হচ্ছে, শুধু আমটাই পড়ছে না। কখন পড়বে অপেক্ষা করতে করতে এবার রাগ হচ্ছে নিতুর। ভারি অভিমানে বলল, ‘শোনো পাকা আম, বড্ড পেকে গেছো হ্যাঁ! একেবারেই কথা শুনছো না। এখন যদি না পড়ো তো সত্যি সত্যিই চলে যাব। তখন তুমি মাটিতে পড়ে ব্যথা পেলে আমাকে দোষ দিওনা যেন।’
একটা বুলবুলি পাখিকে নিতু রোজ এই আমগাছে বসে থাকতে দেখে। আবার মনে হলো হাঁড়িচাঁচাও হতে পারে। ভাবতে ভাবতে ভীষণ ঝড় শুরু হয়।
নিতুর পেছনে কী যেন একটা ধপাস করে পড়ল। সাথে সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে একটা আধ খাওয়া আধাপাকা আম। তবে কি এটাই এতক্ষণ ধরে দেখছিল সে! ফের উপরে তাকায়। না! এটা ওটা নয়। যেটা নিতু এতক্ষণ ধরে দেখে আসছে ওটা আগের জায়গাতেই রয়েছে। ওইতো দেখা যাচ্ছে একঝাঁক সবুজ পাতার দোলনায় আরামসে বসে আছে আর হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। ওদিকে মা হেসে বলছে, ‘এত কষ্ট করে দাঁড়িয়ে শেষে পক্ষী খাওয়া আম! বলি ঘরে এতো ভালো আম রয়েছে, কথা শুনতে পাস না বুঝি! চলে আয়।’
নিতুর বাবা আবার উল্টো করে বলল, ‘মার কথা শুনিস না নিতু, তোকে আজ ওই আমটা নিয়েই ঘরে ফিরতে হবে। তুই এলে পরে কেটে নুন দিয়ে মেখে আমরা বাপবেটি মজা করে খাব। আঁটিটা কিন্তু আমার, আগেই বলে দিলাম হুম!’
একদিকে নিতুর বাবা-মায়ের খুনসুটি চলছে, অন্যদিকে নিতু পাখি খাওয়া আধপাকা আম নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত। আমটার গায়ের কামড়ে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কোন পাখি খেয়েছে। একবার মনে হচ্ছে বুলবুলি হবে। একটা বুলবুলি পাখিকে নিতু রোজ এই আমগাছে বসে থাকতে দেখে। আবার মনে হলো হাঁড়িচাঁচাও হতে পারে। ভাবতে ভাবতে ভীষণ ঝড় শুরু হয়। মা ওদিক থেকে ডেকেই চলেছে- ‘এখনি বৃষ্টি নামবে, ঘরে চলে আয় নিতু। তাড়াতাড়ি আয় বলছি।’ এবার বাবাও ডাকছে, ‘এখন চলে আয় নিতু। ঝড় থামলে ওই আমটা আমিই তোকে পেরে দেবো। জলদি চলে আয়, মা।’
এরকম ঝড়ের সময় বাইরে থাকতে হয় না। তাছাড়া মা-বাবা দুজনই এত করে ডাকছে। নিতু ঘরে চলে যাবে তাই শেষবারের মতো উপরে তাকিয়ে দেখে এমা! সত্যি সত্যিই আমটা এবার পড়ছে। দেখে সে কি উচ্ছ্বাস নিতুর! খুশিতে লাফিয়ে ওঠে আর ধপাস করে ওর হাতের মুঠোয় এসে কী যেন পড়ল!
ভালো করে তাকিয়ে নিতু দেখে এটা আম নয়, হলুদ স্কচট্যাপে মোড়া একটা টেনিসবল। সকালে খেলার সময় নিনাদ ছক্কা হাঁকিয়ে যেটা হারিয়ে ফেলেছিল।