ইতিহাস থেমে থাকেনি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুন ২০২৩, ৩:২৭:২৭ অপরাহ্ন
মো. মোস্তফা মিয়া
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলার হত্যার পর মীরজাফর সিদ্ধান্ত দিলেন লুৎফুন্নেসা ও তাঁর কন্যা যোহরা, সিরাজ মাতা আমেনা বেগম, খালা ঘষেটি বেগম এবং সিরাজের নানী সরফুন্নেসাসহ আরো অনেককে নির্বাসনে পাঠানো হবে ঢাকার জিনজিরায়। ১৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দে নবাব পরিবারের এই সদস্যদের ঠাসাঠাসি করে তোলা হলো একখানা সাধারণ নৌকায় এবং পাঠানো হলো ঢাকার জিনজিরায়।
সিরাজউদ্দৌলা যখন মুশির্দাবাদে হত্যা হোন, জেসারত খাঁ ছিলেন সেসময় ঢাকার নায়েব-ই-নাজিম। নবাব আলীবর্দী খাঁর জামাতা নাওয়াজিস খাঁর ইন্তেকালের পরই জেসারত খাঁকে ঢাকার নায়েব- নাজিম করা হয়। জেসারত খাঁ জাতিগতভাবে ছিলেন ইরানী।
নবাব আলীবর্দী খাঁ তখন বাংলার এই অঞ্চলে বর্গী দমনে অতিশয় ব্যস্ত। একদিন অকস্মাৎ নবাব আলীবর্দী খাঁর নজরে পড়েন রোগাগ্রস্ত প্রবাসী জেসারত খাঁ। রাস্তার ধারে ক্ষুধা- ব্যাধির যন্ত্রণায় তিনি তখন কাতর। পথ দিয়ে যাবার সময় তার সুন্দর দেহ সৌষ্ঠব দৃষ্টি আকর্ষণ করে নবাব আলীবর্দী খাঁর। তিনি এগিয়ে যান তার কাছে। সব শুদ্ধ উঠিয়ে নেন ঘোড়ায়। প্রত্যাবর্তনের পথে নিয়ে যান মুশির্দাবাদে। ব্যবস্থা করেন উপযুক্ত চিকিৎসার। রাজবৈদ্যের সুচিকিৎসায় অচিরেই সুস্থ হয়ে ওঠেন যুবক জেসারত খাঁ। নবাব তাঁর বুদ্ধিমত্তায় হন মোহিত। দীক্ষা দেন তাঁকে রাজকার্যে। তারপর তাকে জামাতা নওয়াজিশ খাঁর সাথে পাঠিয়েছিলেন ঢাকায়। পরবর্তীকালে নিজগুণে ভূষিত হন নায়েব-ই-নাজিমের পদে। মীর জাফরের আমলেও অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি সেই পদে। কিন্তু অন্যায় আব্দার প্রতিপালনে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে কোপাদৃষ্টিতে পড়েন শাহজাদা মীরণের। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করে মীরণ ইংরেজদের মনে আস্থা জন্মাতে পেরেছিলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি আরো ঘটিয়েছিলেন কয়েকটি ঘটনা। সামান্য কারণে এই দানব নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন উচ্চপদস্থ দু’জন ইংরেজ বিদ্বেষী প্রভাবশালী সরকারি কর্মচারীকে। নিজহাতে তরবারির আঘাতে শিরচ্ছেদ করেছিলেন দু’জন পর্দানশীন হেরেম বাসিনীকে। সে সময় এ ধরণের ঘটনা
হেরেমের অভ্যন্তরে ছিল অভাবিত। রাজধানীর সম্মানিত মানুষ তাই সঙ্গত কারণেই তার উপর হয়ে পড়েছিল বিরুপ। তার ভয়ে সর্বক্ষণ থাকতো তটস্থ।
নবাব আলীবর্দী খাঁ ব্যক্তিগত তত্বাবধানে রেখে নাতিকে (সিরাজকে) গড়ে তুলে ১৮ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন নিজের পরিবারের আশৈশব সুশিক্ষিত পরমাসুন্দরী লুৎফুন্নেসার সাথে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে বিপুল উৎসব আয়োজন করে। লুৎফুন্নেসা বেগম সিরাজের প্রথম সহচরে পরিণত হন। সিরাজের প্রথম স্ত্রী উমদাতুন্নেসা (বহু বেগম) সবসময় আনন্দ-বিলাসেই মগ্ন থাকতেন। পলাশী বিপর্যয়ের পর সিরাজ একাকী পলায়নের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু লুৎফুন্নেসা তাঁকে সঙ্গী করার জন্য আকুল আবেদন জানান। সিরাজ তাঁর বিশ্বস্ত স্ত্রী লুৎফুন্নেসা, তাঁদের একমাত্র কন্যা যোহরা এবং একজন অনুগত খোজা সহ ১৭৫৭ সালের ২৪ জুন গভীর রাতে নিভৃতে মুশির্দাবাদ শহর ত্যাগ করেন। হতভাগ্য সিরাজ পলায়ন করতে গিয়ে মীর জাফরের ভ্রাতা মীর দাউদের হাতে অচিরেই ধরা পড়েন রাজমহলে। মীর জাফরের জামাতা মীর কাসিম সেখানে গিয়ে তাঁকে ধরে নিয়ে আসেন মুশির্দাবাদে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা গ্রেপ্তার হওয়ার পর মীর কাসিম লুকানো সোনা-দানার সন্ধান চেয়ে লুৎফুন্নেসার ওপর অমানবিক অত্যাচার করেন। এদিকে মীর জাফরের পুত্র মীরণের আদেশে মুহম্মদী বেগ ১৭৫৭ সালের ৩’রা জুলাই সিরাজকে নিমর্মভাবে হত্যা করেন এবং মীর জাফরের পুত্র মীরণের নির্দেশে তাঁর মৃতদেহ হাতির পিঠে করে সারা মুর্শিদাবাদ নগরে অত্যন্ত অপমানজনক অবস্থায় প্রর্দশনের ব্যবস্থা করেন। নবাবের স্ত্রী, মা এবং অনেক আত্মীয়স্বজন তখন বন্দী ছিলেন। তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তারা আলীবর্দী খাঁর বিখ্যাত আম খেতে চান কিনা (মালদহের বিখ্যাত ফজলী আম)। অশ্রুসজল নয়নে ক্ষুধার্ত অবস্থায় তারা ইঙ্গিতে সম্মত দিয়েছিলেন। তারপর করুণার জীবন্ত ছবি ইংরেজ সরকারের আদেশ অনুযায়ী অর্ধভর্তি আমের বস্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছিল তাদের কাছে। নবাব পরিবারের সব মহিলার পক্ষ থেকে একজন বস্তার মুখ খুলতেই দেখতে পেলেন ভেতরে আম নেই বা অন্য কোনো খাদ্যদ্রব্যও নেই। আছে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বীভৎস কাঁচা কাটা মাথা। নবাব যেনো তাঁর গর্ভধারীণী মায়ের সাথে শেষ দেখা করতে এসেছেন। নবাবের হতভাগী মা’ প্রিয় পুত্রের মুখের দিকে তাকাতেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
স্বামীর শাহাদতের পর সিরাজের তরুণী বিধবা স্ত্রী লুৎফুন্নেসা মীর জাফর ও মীরণের বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখান করে সারাজীবন অর্থাৎ দীর্ঘদিন স্বামীর কবরে পবিত্র কুরআন শরীফ পাঠ করে সময় অতিবাহিত করেছেন। আসলে নবাব সিরাজের চরিত্রের ওপর লুৎফা বেগমের বিরাট প্রভাব পড়েছিল। উন্নত চরিত্র গুণাবলীর অধিকারীনি লুৎফা সারাজীবন সিরাজউদ্দৌলার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। নবাবের পতনের পর লুৎফুন্নেসা সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিন অতিবাহিত করেন। লুৎফুন্নেসা খোশ বাগে সিরাজের কবরের পাশে একখানি কুড়ে ঘর তৈরী করে বাকী জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দেন। কতবড় বিদূষী ও মহীয়সী নারী হলে জীবনের সব লোভ ও আয়েশ পরিত্যাগ করে তিনি জীবনের বেশীরভাগ সময় প্রাণাধিক প্রিয় স্বামী সিরাজের ধ্যানে কাটিয়ে দেন। তিনি মাসিক যে মাসোহারা পেতেন তা’ দিয়ে প্রতিদিন কাঙ্গালীভোজের ব্যবস্থা করতেন। তিনি সূদীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে এভাবে স্বামীর সেবা করে ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে নভেম্বর পরলোক গমন করেন এবং মুর্শিদাবাদের খোশবাগে সিরাজের পদতলে তিনি সমাধিস্থত হন। লুৎফুন্নেসার একনিষ্ঠ প্রেম, ভালবাসা এবং ত্যাগ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালে সমূজ্জল হয়ে থাকবে।
যাকে নিয়ে এ লেখা, পলাশীর ইতিহাসে তাঁর অস্তিত্বের উপস্থিতি কখনো দিপ্ত স্বরব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু পলাশী কখনো তাঁকে পাশ কাটিয়েও যেতে পারেনি, তিনি এক নারী নাম তাঁর বেগম লুৎফুন্নেসা। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সহধর্মিনী। পলাশী বিপ্লব ২০২৩ সালে ২৬৬ বছর অতিক্রম করছে। কিন্তু তেমন সরবে আসতে পারেন নি দূর্ভাগা নারী লুৎফুন্নেসা। ইতিহাসে বার বার উপেক্ষিতা রয়ে গেছেন তিনি। সিরাজকে হত্যা করে নবাব হলো মীর জাফর। তাঁকে নবাব বানালেন ক্লাইভ। সিরাজউদ্দৌলার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ১৫ বছরের মির্জা মেহেদীকে হত্যা করা হলো মীর জাফর ও মীরণের নির্দেশে। অন্ধকার কারাগারে প্রকোষ্ঠে হত্যা করা হলো নির্মমভাবে মির্জা মেহেদীকে (নিহত ১৭৫৭ খ্রি:)। কারাগারে পুরলেন সিরাজের মা’ আমেনা বেগম, নবাব আলীবর্দী খানের (১৭৪০-১৭৫৬ খ্রিঃ) পতী সরফুন্নেসা, নবাব সিরাজউদ্দৌলার অর্ধাঙ্গিনী লুৎফুন্নেসা ও তাঁর ৪ বছরের শিশু কন্যা উম্মে যোহরাকে। ঘষেটি বেগম কেও কারাগারে পুরলেন। আজকের ঢাকার গা’ ঘেষে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গার ওপারে জিনজিরার প্রাসাদে নির্বাসনে পাঠালেন। নামে প্রাসাদ। আদতে কয়েদখানারও অধম। সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
সিরাজউদ্দৌলার হত্যার পর (৩’রা জুলাই ১৭৫৭ খ্রিঃ) মীর জাফর সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন লুৎফুন্নেসা ও তাঁর কন্যা উম্মে যোহরা, শাশুড়ী সিরাজ মাতা আমেনা বেগম, খালা ঘষেটি বেগম এবং সিরাজের নানী সরফুন্নেসাকে নির্বাসনে পাঠানো হবে জিনজিরায়। ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে নবাব পরিবারের এই সদস্যদের ঠাসাঠাসি করে তোলা হয়েছিল একখানা সাধারণ নৌকায় যা’ পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের খাওয়া দাওয়া বাবদ সে সময় সামান্য অর্থ আসতো অনিয়মিত। ফলে চরম দারিদ্রের মধ্যে দিনযাপন করতে হয়েছে তখন এসব পরিবারের নারীদের। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে রেযা খাঁকে ঢাকার নায়েব সূবাদার করা হলো। তিনি নবাব পরিবারের এই নারীদের জন্য সামান্য ভাতা বরাদ্দ করেন। সাত সাতটি বছর পর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে ঢাকার জিনজিরার বন্দীখানা থেকে মুক্তি পেয়ে মুশির্দাবাদ এলেন লুৎফুন্নেসা, তাঁর কন্যা উম্মে যোহরা ও আলীবর্দী খাঁর পতœী সরফুন্নেসা। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী লুৎফুন্নেসা ও তাঁর কন্যার ভরণ পোষণের জন্য মাসিক ৬০০/- টাকা বরাদ্দ করেন। ক্লাইভের নির্দেশে লুৎফুন্নেসা ও তাঁর কন্যা উম্মে যোহরাকে মুশির্দাবাদে আনা হয়েছিল। ক্লাইভের এ নির্দেশের বিরুদ্ধে যাবার দূঃসাহস ছিলনা ‘ক্লাইভের গর্দভ মীর জাফরের’। পাপিষ্ঠ মীর জাফর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারী দূরারোগ্য কুষ্ঠ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
ঢাকার জিনজিরার প্রাসাদ কয়েদখানার প্রতিটি ইটে মিশে থাকা লুৎফুন্নেসা, আমেনা বেগম, সরফুন্নেসা ও ঘষেটি বেগমের বুকভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাস, আর্তনাদ ও গোঁঙ্গানির কান্নার আওয়াজ আজও শুনতে পাওয়া যায়। ইতিহাসের ছাত্র কান পাতলেই তা’ শুনতে পাবে। সেই ইতিহাস আমাদের পূর্বপুরুষের করুণ ইতিহাস। সেই ইতিহাস এক অব্যক্ত বেদনার ইতিহাস।
তাই আজ এতদিনে জেগে উঠেছে সিরাজউদ্দৌলার বংশধরদের ইতিহাস। ইতিহাস কখনোই থেমে থাকেনি।