ঈদুল আজহা ও কোরবানি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জুন ২০২৩, ৬:৫২:০৫ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী
‘
কোরবানি’ শব্দ টি ‘ক্কুরবুন’ ধাতু থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তা’লার নৈকট্য অর্জন করার বস্তু। ‘কুরবান’ অর্থাৎ উৎসর্গ করা, ধ্বংস করা, ত্যাগ করা ইত্যাদি। মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভ করার উপায় হল দুটি-প্রথমত তাঁর আদেশ যথাসাধ্য নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করা। দ্বিতীয়ত, তাঁর নিষিদ্ধ কর্মসমূহ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা। আর এজন্য কখনো নিজের খেয়াল-খুশিকে, কখনো ধন-সম্পত্তি তথা নিজের জীবনেরও কোরবানি পেশ করতে হবে। একজন প্রকৃত মুমিনের মধ্যে সর্বদা আল্লাহতা’লার নৈকট্য লাভের জন্য সবকিছুকে ত্যাগ ও উৎসর্গ করার পূর্ণ স্পৃহা থাকাটাই বাঞ্চনীয়। ইসলাম নামকরণকারী মহান পুরুষ হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জীবনে এই তিনটি জিনিসের বাস্তব নমুনা খোঁজার চেষ্টা করা যাক।
হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর নেতৃত্ব পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের কাছে গ্রহণীয়। খ্রিস্টান, ইহুদি এবং মুসলমান সকলেরই তাঁর সাথে ভালোবাসা তথা আধ্যাত্মিকতার সম্পর্ক আছে। কেননা, হযরত মুসা (আ.) হযরত ইশা (আ.) এবং হযরত মোহাম্মদ (স.) তিনজনই তাঁর বংশধর। একত্ববাদের এই ঘোষণাকারী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা জীবনটাই ইসলাম, জেহাদ ও কোরবানির বাস্তব চিত্র। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে বর্তমান ইরাকে হযরত ইব্রাহিম (আ.) জন্মগ্রহণ করেন।
সমস্ত পৃথিবীবাসী নিজ সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে গিয়ে চন্দ্র-সূর্য, গাছ-পালা তথা পাথরের এবাদতে মগ্ন ছিল। পৃথিবীবাসী অত্যন্ত আগ্রহে বিভিন্ন দেবদেবির এবাদতে নিমজ্জিত ছিল। মূর্তির নিকট নিজের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের প্রার্থনা ও মানত প্রথা প্রচলিত ছিল। মোটকথা, পৃথিবীবাসী নিজ ¯্রষ্টার গোলামি ত্যাগ করে, সৃষ্টির গোলামিতে নিয়োজিত ছিল। স্বয়ং হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর বংশধর কেবল মূর্তিপূজকই ছিলেন না বরং তাঁরা এই প্রথার রক্ষকও ছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জন্মের পর গ্রামেগঞ্জে কত না খুশির হাওয়া বয়েছিল। আর তাঁর প্রতি নিজের পরিবার তথা দেশবাসীর কতই না আশা-ভরসা ছিল যে, ভবিষ্যতে তিনিই বংশের ঐতিহ্যটি বহাল রাখবেন। কিন্তু জ্ঞান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জ্ঞানচক্ষু ও অন্তর্দৃষ্টি যতই উম্মোচিত হতে লাগল ততই নিজের পরিবার ও সম্প্রদায়ের কার্যকলাপ ও বিশ্বাসের প্রতি তাঁর অনীহা জন্মাতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজ সম্প্রদায়কে সৃষ্টিকর্তার সন্ধান দিতে, প্রজ্ঞার সাথে একে একে চন্দ্র-সূর্য ও তারকারাজিকে নিজের প্রভু বলে সাময়িকভাবে ধরে নিলেন। পরে যখন এগুলো অস্তমিত হয়ে গেল তখন তিনি জাতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন যে, ‘আমি অস্তগামীদের ভালোবাসি না’। তাঁরা কিন্তু হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কথার মর্ম উপলব্ধি করতে না-পেরে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে গেল। হযরত ইব্রাহিম (আ.) দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে, ‘হে আমার গোত্র তোমরা যে সব বিষয়কে শরিক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত। আমি একমুখী হয়ে স্বীয় আনন ঐ সত্ত্বার দিকে করেছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন। এবং আমি মুশরিক নই।’ (৬ : ৭৮-৭৯)
যেখানে নিজ সম্প্রদায় তথা গোটা পৃথিবীতে যে প্রথাটি শুধু প্রচলিতই ছিল না, তার সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসও জড়িত ছিলÑএরূপ প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলা কি বিদ্রোহ নয়? নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করার নামান্তর নয় কি? তা কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়? কোন জিনিসটি তাঁকে এই বিদ্রোহে তথা জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে আত্মাহুতি দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল? কীসের নেশায় মত্ত হয়ে তিনি নিজ মাতৃভূমিকে ত্যাগ করে অচেনা-অজানা পথের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়েছিলেন? তা ইসলাম, জেহাদ ও কোরবানির বাস্তব রূপ নয় কি? বৃদ্ধ বয়সে প্রাপ্ত একমাত্র ছেলের গলায় ছুরি দিতে কে তাঁকে প্রস্তুত করেছিল? এই ছিল পূর্ণ ইসলাম, জেহাদ ও কোরবানির বাস্তব ছিত্র। আর সেজন্যই তিনি আল্লাহতা’লা কর্তৃক গোটা মানবজাতির ‘নেতা’ ও আল্লাহ’র বন্ধুরূপে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এখানে আল্লাহতা’লার উদ্দেশ্য হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পুত্রকে জবাই করা ছিল না বরং তা মহব্বতের জবাই ছিল যা আল্লাহতা’লার মহব্বতের অংশীদার বা তাঁর মহব্বতের প্রতিবন্ধক। তা ছিল আল্লাহতা’লার মহব্বত ব্যতীত অন্য সকল জিনিসের মহব্বতের কোরবানি যা পূর্ণ আনুগত্য ও দাসত্বের উৎকৃষ্ট নমুনা, যা মহান আল্লাহর নির্দেশের সামনে নিজেকে বিলীন করার ও তাঁর রাস্তার সংগ্রাম তথা নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুর কোরবানি পেশ করার বিরল দৃষ্টান্ত। তা ছিল রাস্তার ধৈর্য্য ও কৃতজ্ঞতা তথা সংগ্রামের সেই পরীক্ষা যা ব্যতিরেকে ইহজগতের নেতৃত্ব ও পরজগতের চিরন্তন সুখের আশা করা অবান্তর। যা পিতার একমাত্র পুত্রের রক্ত দ্বারা পৃথিবীকে রঞ্জিত করা ছিল না বরং তা ছিল নিজের সমস্ত আশা-আকাক্সক্ষা ও খেয়াল-খুশির কোরবানি।
প্রতিবছর ঈদ-উল-আজহা পালনের সময় পশুদের কোরবানি দেওয়ার প্রথা তা সেই মহান কোরবানিরই অনুকরণ ও স্মারক, অভ্যন্তরীণ তাৎপর্যের বাহ্যিক প্রকাশ। একজন মুসলমান পশু জবাই করার সময় মুখে উচ্চারণ করে যে, ‘নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার সর্বপ্রকার এবাদতসমূহ, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছুই বিশ্ব প্রতিপালকের জন্যই নিবেদিত। উক্ত স্বীকারোক্তির মাধ্যমে পশুর গলায় ছুরি চালনা করে এ কথারই বাস্তব চিত্র পেশ করে যে, আল্লাহতা’লার মহব্বত ও তাঁর নির্দেশের সামনে নিজের সকল প্রিয় বস্তুর কোরবানি এমনকি নিজের প্রাণেরও কোরবানি পেশ করতে সে সদা প্রস্তুত। আর যদি সেই অনুভূতি ও স্পৃহা না থাকে তবেও কি তা কোরবানি? না, তা কোরবানি নয় বরং বাহ্যিক একটি অনুষ্ঠানÑআল্লাহতা’লার নিকট যার কোনো মূল্য নেই। সেই চেতনা, অনুভূতি ও স্পৃহাহীন কোরবানি সম্বন্ধে মহান প্রভুর ঘোষণা হচ্ছে যে, ‘এগুলোর মাংস ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া।’
উপরোক্ত আলোচনা থেকে কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়েছে যে, ইসলাম জেহাদ ও কোরবানি তিনটি শব্দই একটি অপরটির পরিপূরক। একজন পূর্ণাঙ্গ মুসলিমÑযে মুসলিমের জন্য ইহজগতের নেতুত্ব ও পরজগতের চিরন্তন সুখের সু-সংবাদ দেওয়া হয়েছে তাঁর মধ্যে এই তিনটি জিনিষের বাস্তব চিত্র থাকাটাই বাঞ্ছনীয়।
আজ আন্তর্জাতিকভাবে আমরা পদদলিত ও নির্যাতিত হওয়ার প্রধান কারণ হল যে, আমরা ইসলামকে জেহাদ ও কোরবানির মর্ম থেকে পৃথক করে দিয়ে বাহ্যিক কয়েকটি অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে নিয়েছি। জেহাদকে যুদ্ধের সমার্থবোধক মনে করে নিজের জীবন থেকে বিদায় দিয়েছি আর প্রতি বছর ১০ জিলহজ্জ্বে একটি পশু কোরবানি করে অন্য সকল কোরবানি থেকে নিজেদেরকে দায়মুক্ত করে নিয়েছি।
তাই আসুন, আমরা সকলেই মহান প্রভুর নিকট এ প্রার্থনা করিÑতিনি যেন, আমাদেরকে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মতো ইসলাম, জেহাদ ও কোরবানির পূর্ণ চেতনা ও অনুভূতি দান করেন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।