বঙ্গবীর ওসমানীর গণনীতি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৫:৩১:৫৩ অপরাহ্ন
প্রফেসর আবুল কালাম আজাদ
মহান মুক্তিযুদ্ধে জেনারেল এমএজি ওসমানীর অসাধারণ ভূমিকার জন্য তাঁকে বঙ্গবীর উপাধীতে ভূষিত করা হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসাবে ও সর্বাধিক পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসাধারণ রণকৌশল তথা দিকনির্দেশনার কথা সবাই জানেন।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের (১৯৭০-১৯৮৩) প্রতিটি ক্ষেত্রে আদর্শিক রাজনীতি প্রতিভাসিত হয়েছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে কঠোর শৃংখলা, নিয়মানুবর্তিতা আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুসরণ এবং নিখাদ দেশপ্রেম ছিল তাঁর ব্যক্তি চরিত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য। তাঁর ব্যক্তিজীবনের আদর্শ ও বিশ্বাস এবং রাজনৈতিক জীবনের আদর্শ ও বিশ্বাসের মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না।
১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত তাঁর রাজনৈতিক দল জাতীয় জনতা পার্টির গঠনতন্ত্রে “রাজনীতি” শব্দটির অর্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন রাজনীতি বলতে তিনি বুঝেন গণনীতি। রাজনীতি শব্দটির যথাযথ প্রতিশব্দ হিসাবে ‘গণনীতি’ ব্যবহার করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে আপামর জনসাধারণের সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার সাধারণ নিয়ম-নীতিই গণনীতি। জনগনের স্বার্থ বা কল্যাণের অনুকূলে গৃহীত রাষ্ট্রীয় নীতিই হলো গণনীতি।
১৯৭৮ সালে জাতীয় জনতা পার্টির দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনের এক অধিবেশনে (সিলেটের নাইওরপুলস্থ বাসভবনে) আমার মরহুম পিতা আলহাজ্ব মোঃ আলকাছ মিঞার সাথে আমিও উপস্থিত হই। আমি সে সময় সিলেট সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। ১৯৭৬ সালে জাতীয় জনতা পার্টি গঠিত হলে, ওসমানী সাহেব আমার পিতাকে বালাগঞ্জ থানা কমিটির কোষাধ্যক্ষ পদের দায়িত্ব প্রদান করেন। দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে আমার পিতা থানা কাউন্সিলর হিসাবে যোগদান করেন।
ওসমানী সাহেব প্রায় দেড় দশক প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে ছিলেন। সাহসী ও সত্যানুরাগী হিসাবে তাঁর পরিচিতি ছিল। তাঁর বিশ্বাস ও অনুভবে সত্য লুকায়িত ছিল। তিনি যা বিশ্বাস করতেন ও সত্য বলে মনে করতেন, তা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতেন। তাঁর চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের ন্যায্য অধিকার। পরিশীলিত ভাষা ব্যবহার বা শব্দচয়নের ক্ষেত্রে তাঁর সুনাম রয়েছে।
হালে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে চরম আক্রমণাত্মক ভাষা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের অবাধ ব্যবহার আমাদেরকে সত্যিই হতাশ করে। হিংসা-বিদ্বেষ ও কাঁদা-ছোড়াছুড়ির ধারে কাছেও ওসমানী সাহেব ছিলেন না। তাঁর বক্তৃতা বা আলাপ-আলোচনার মধ্যে এক উচ্চমার্গিক রুচিশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৭৫ সালে ‘বাকশাল’ গঠিত হলে জেনারেল ওসমানী বাকশালে যোগ না দিয়ে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করলেন। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আজীবন শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি ছিলেন আপোসহীন। অন্তরে যা বিশ্বাস করতেন, তাই মানতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর ডাকেই তিনি রাজনীতিতে আসেন। তিনি কেন বাকশালে থাকলেন না, বা সংসদ থেকে পদত্যাগ করলেন, তার কারণ ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। সেই চিঠির শুরুতে “প্রিয় বঙ্গবন্ধু” বলে সম্বোধন করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত শালীন ও সংযত ভাষায় তাঁর গণতান্ত্রিক বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও রাজনৈতিক অভিলাশের চুল-চেরা বিশ্লেষণ ঐ চিঠিতে করেছিলেন।
অনেকে বলেন, তিনি ব্রিটিশ-মডেলের বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক ধারা বা মূল্যবোধের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি সংসদীয় পদ্ধতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং আজীবন বিশুদ্ধ বা নির্ভেজাল গণতন্ত্রী ছিলেন। যথার্থ অর্থে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন পাঁচ দফা দাবীর (সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে) প্রেক্ষিতে বর্জন করেছিলেন। সে সময় সকল দল (সকল মত ও পথের) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে জাতীয় জনতাপার্টির ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্র ফ্রন্ট সিলেট জেলা কমিটির আহবায়কের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়। পরবর্তিতে জাতীয় ছাত্রফ্রন্টের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
আজকাল রাজনীতিতে স্বার্থবুদ্ধি বা ব্যবসাবুদ্ধি ছাড়া কাউকে পাওয়া দুষ্কর। ব্যক্তিস্বার্থ বা দলীয় স্বার্থ বা গোষ্ঠী স্বার্থকে বর্জন করে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার মতো মহৎ মানুষের খুব অভাব পরিলক্ষিত হয়। জেনারেল ওসমানীর দেশ-প্রেমের মধ্যে কোনো ভনিতা ছিলনা। সবকিছুর উর্দ্ধে দেশ বা জাতি বা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ তাঁর কাছে প্রথম বিবেচ্য বিষয়। জাতীয় বিপর্যয়ে একজন সত্যিকার ত্রাণকর্তা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। ৩০ মে ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যাকান্ড এবং তৎপরবর্তি অনাকাংখিত ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে টেলিভিশনে জেনারেল ওসমানীর নির্দেশনামূলক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ বার বার প্রচারের ফলে পরিস্থিতি শান্ত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। অথচ ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের কাছে ওসমানী সাহেব পরাজিত হয়েছিলেন।
সর্বাধিনায়ক বা প্রধান সেনাপতি শব্দ দুটির ইংরেজী ও বাংলা অর্থের মধ্যে পার্থক্য বা সাদৃশ্য থাকা স্বাভাবিক। সত্তরের দশক বা আশির দশকের শুরু পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁর নামের সাথে সর্বাধিনায়কই ছিল। স্বাধীনতা উত্তর কাল থেকে আশির দশক পর্যন্ত একমাত্র ‘বঙ্গবীর’ উপাধিটি উনারই ছিল। যতটুকু মনে পড়ে উনার মৃত্যুর পরে বা তারও পরে উপাধিটি অনেকটা হাইজেক এর মতো হয়ে যায়, যা অত্যন্ত বেদনার বিষয়।
এই আদর্শ পুরুষ, বিশ্বস্তজন, সৎ-নীতিবান রাজনীতিবিদ ও সমরবিদের জন্ম হয় ১লা সেপ্টেম্বর ১৯১৮ সালে এবং মৃত্যু হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ সালে। হযরত শাহজালালের (রঃ) মাজারের পাশে তিনি শায়িত আছেন।
লেখকঃ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ।