এখনো খেয়া নৌকাই ভরসা পূর্বাঞ্চলের মানুষের
দিরাইয়ে ২২ কোটি টাকার কালনী সেতু কাজে আসছেনা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ নভেম্বর ২০২৩, ৮:৩৪:৫২ অপরাহ্ন
মো. উবাইদুল হক দিরাই (সুনামগঞ্জ) থেকে : সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহাসিক কালনী নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৩২ কিলোমিটার। গড় প্রস্থ ৫৭ মিটার। এই নদীর পাড়েই দিরাই উপজেলা সদর ও পৌরসভা। উপজেলার পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি ইউনিয়নে প্রায় লক্ষ মানুষের বসবাস। এই মানুষদের চলাচলের ভরসা দিরাই বাজারের হাইস্কুলের পাশে কালনী নদীর খেয়া নৌকা। শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হেঁটে অথবা মোটরসাইকেল আর বর্ষা মৌসুমে নৌকাযোগে উপজেলা সদরে যাতায়াত করেন পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দারা। যুগ যুগ ধরে যোগাযোগ সমস্যার কারণে কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত এলাকার কৃষকরা।
এসব সমস্যা সমাধানে স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে দিরাই উপজেলা সদরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কালনী নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ হয়। কিন্তু সেতুর পূর্ব পারে সংযোগ সড়কের পর আর কোন সড়ক নেই। ফলে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে নির্মিত সেতুটি কোন কাজে আসছেনা দিরাইবাসীর। দিরাই-শাল্লা নির্বাচনী এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের স্বপ্ন ছিল এই সেতুটি সড়কে যুক্ত হবেন পূর্ব দিরাইয়ের বাসিন্দারা। আর এ সড়কটি দিরাই উপজেলার হোসেনপুর থেকে জগন্নাথপুর উপজেলার কলকলিয়া হয়ে পাগলা-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি সড়কে যুক্ত হবে। এর ফলে ভাটির উপজেলা দিরাইয়ের মানুষ ২০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ বাঁচিয়ে উপজেলা সদর থেকে বিভাগীয় শহর সিলেট বা রাজধানী ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন। কিন্তু নির্মাণের ৮ বছর পার হলেও সেতুটি ব্যবহার হচ্ছে না। সেতু থাকলেও রাস্তার সংযোগ স্থাপন হয়নি আজও।
এ অবস্থায় এখনো মানুষকে কালনী নদী পাড়ি দিতে খেয়া নৌকার উপর তাদের ভরসা। এতে করে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য বহন করে প্রতিদিন দিরাই বাজারের হাইস্কুলের পাশে কালনী সেতুর অর্ধ কিলোমিটার দূরে খেয়াঘাট দিয়ে চলে যাত্রী পারাপার।
এলাকাবাসী জানান, প্রতিটি গ্রামের মানুষকে উপজেলা শহরে যেতে হলে বেশি সময় নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হয়। এ ছাড়াও উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারে নিতে বা বাজার থেকে ক্রয় করা পণ্য আনতে খেয়া পারাপারের সময় কৃষককে ব্যয় করতে হয় অতিরিক্ত অর্থ।
এ কারণে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করেও লাভের মুখ দেখতে পারেন না হাওরাঞ্চলের কৃষকরা। এভাবেই বর্ষায় নৌকা কেন্দ্রিক ও হেমন্তে পায়ে হাঁটা যোগাযোগ ব্যবস্থায় অপচয় হয় নাগরিক শ্রম ও অর্থ। স্থানীয় এলাকাবাসীর দাবি, কালনী সেতু হয়ে কলকলিয়া রাস্তা নির্মাণ করা হলে এই এলাকার জনগণের যেমন দুর্ভোগ কমবে, তেমনি বদলে যাবে অর্থনীতির গতিপথ। সরাসরি ঢাকার সাথে সড়ক যোগাযোগ সৃষ্টি হবে। প্রসার ঘটবে স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্যের।
সরেজমিনে এলাকাবাসীর সাথে আলাপকালে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ থেকে একসনা ইজারা দেয়া হয়েছে হাইস্কুলের পাশের খেয়াঘাট। একজন যাত্রী একবার খেয়া পারাপারের ভাড়া তালিকায় লেখা আছে ৪ টাকা, প্রতি মন মালামালের ভাড়া ১ টাকা। কিন্তু যাত্রীদের কাছ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিস্তর অভিযোগ করেন এলাকার মানুষজন। কালনী নদী পার হতে জনপ্রতি ১০-১৫ টাকা দিয়ে খেয়া নৌকায় উপজেলা সদরে যাচ্ছেন লোকজন। যাদের চলাচলের মাধ্যম এই ঘাট।
প্রতিদিন নৌকায় পারাপার হতে হয় স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ পথচারীদের। এই নৌকা দিয়েই চলাচল করে করিমপুর, জগদলসহ আশপাশের উপজেলা ও ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ। জানা যায়, কালনী সেতুর সাথে রাস্তার সংযোগ না থাকায় ওই এলাকার প্রায় শত গ্রামের মানুষ যোগাযোগের মতো সাধারণ নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত হয়ে আছে। প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হন শিশু, বৃদ্ধ ও শিক্ষার্থীরা।
বর্ষাকালে নদীতে পানি বেড়ে গেলে শিশু শিক্ষার্থীদের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। নিজ সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে অজানা আশঙ্কায় অপেক্ষায় থাকেন অভিভাবকরা। করিমপুর গ্রামের বাসিন্দা আল আমিন বলেন, সারা জীবন আমাদের বাবা-দাদারা দাড় টানা খেয়া নৌকা দিয়ে নদী পার হয়েছেন। এখন আমরা ইঞ্জিন চালিত খেয়া নৌকা দিয়ে পার হই। উন্নয়ন বলতে এতটুকুই।
২২ কোটি টাকার সেতু চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শুধুমাত্র রাস্তার অভাবে একটি গ্রাম ছাড়া আর কোন গ্রামের মানুষ সে সেতু ব্যবহার করতে পারছে না। দিরাই উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী মুক্তি বিশ্বাস জানায়, প্রতিদিন তাদের তিন থেকে চারবার নৌকা দিয়ে নদী পারাপার হতে হয়। এতে তার মতো শত শত ছাত্রছাত্রীর টাকা ও সময় নষ্ট হচ্ছে, পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে।
উপজেলার জগদল ইউনিয়নের রাঁজনাও গ্রামের বাসিন্দা সুমন দেব বলেন, কালনী নদীর খেয়া আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আমরা জেলা কিংবা পৌর শহরে যেতে প্রতিদিন এই ঘাট দিয়ে নদী পার হই, কিন্তু ঘাটে আসলে যখন দেখি ৪ টাকার ভাড়া ১০ টাকা দিতে হয় তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়। ঘাটের দায়িত্বরত মসাদ মিয়া বলেন আমরা ঘাটের ভাড়া জনপ্রতি ৮ টাকা করে রাখি। কিন্তু আজ কয়দিন যাবত পৌরসভার হাই স্কুল রোডের রাস্তার মেরামতের কাজ চলছে, তাই আমাদের নৌকা পারাপারের দূরত্ব একটু বাড়ছে। এই কারণে গত কয়দিন ধরে ১০ টাকা করে ভাড়া রাখছি।
খেয়াঘাট পরিচালনাকারী ইজারাদার জামাল মিয়া বলেন, পেশাদার পাটনি হিসেবে আমরা এক বছরের জন্য ঘাটটি পেয়েছি। এ বছর জেলা পরিষদ থেকে ১৬ লাখ টাকায় এক বছরের জন্য ঘাট ইজারা নেয়া হয়েছে। যাত্রী প্রতি ৮ টাকা করে ভাড়া আদায় ও প্রতিদিন খরচ বাদে বাকি টাকার ২০ শতাংশ নিয়ে থাকি। যাত্রীদের বসার স্থানসহ ঝড় বৃষ্টিতে সমস্যার ব্যাপারেও তিনি বলেন, এত অল্প আয় দিয়ে তেমন কিছু করা সম্ভব না।
এলজিইডির দিরাই উপজেলা প্রকৌশলী ইফতেখার হোসেন বলেন, কালনী সেতুর সংযোগ সড়কের সঠিক কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে শুনেছি হাওরের পরিবেশ রক্ষায় আড়াই কিলোমিটার উড়াল সড়কসহ এই সড়কের জন্য প্রায় ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।