পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা
হবিগঞ্জের হাওর ও কৃষি জমিতে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৪১:৪৮ অপরাহ্ন
মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল, হবিগঞ্জ প্রতিনিধি : হবিগঞ্জের বিভিন্ন হাওর ও কৃষি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় সংকুচিত হচ্ছে হাওর ও কৃষি জমি। একই কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিষ্কাষিত বিষাক্ত বর্জ্যে ফসল ও মৎস সম্পদ বিনষ্ট হওয়া ছাড়াও জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ ব্যাধি। পরিবেশ বিপর্যয়ের এই আশংকা সত্বেও নির্বিকার রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো। জেলার সর্ববৃহৎ ঘুঙ্গিয়াজুরি হাওরে ইদানিং শিল্পপতিদের থাবা পড়ায় হাওরের আয়তন কমে যাওয়া ছাড়াও এর জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুটি বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ওই হাওর এলাকায় কার্যক্রম শুরু করেছে। আরো শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
জানা যায়, গত তিন দশকে মাধবপুর উপজেলার জগদীশপুর থেকে অলিপুর পর্যন্ত স্থানে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের উভয় পার্শ্বে বেসরকারি উদ্যোগে অপরিকল্পিতভাবে অর্ধশতাধিক বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। জমির ক্রয় মূল্য কম, বিদ্যুৎ-গ্যাসের সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রমিক পাওয়া, সর্বোপরি রেল ও সড়ক পথে ঢাকা-চট্টগ্রামের সাথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এখানে এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
রতনপুর-ছাতিয়াইন, পাইকপাড়া-নসরতপুর সড়ক এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মিরপুর-আউশকান্দি অংশে ও বেশ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারিভাবে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের তোয়াক্কা না করে হাওর কিংবা ফসলি জমি বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা (ইটিপি) স্থাপন না করেই উৎপাদনে যাওয়ায় এগুলো থেকে নিষ্কাষিত বিষাক্ত ক্যামিকেল সম্বলিত বর্জ্য খালে-বিলে- নদীতে ছেড়ে দেওয়ায় জেলার মাধবপুর ও লাখাই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিয়েছে। আবার অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ইটিপি থাকা সত্বেও তা যথাযতভাবে ব্যবহার করছেনা বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ৮ নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলা বাপা কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধি দল অলিপুর শিল্পাঞ্চল পরিদর্শন করেন। এ সময় স্থানীয় জনসাধারণ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে নিষ্কাষিত বিষাক্ত শিল্পবর্জ্য ফকিরা খাল, রাজ খাল, খড়কি গাং দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার অভিযোগ করেন। তারা জানান, এতে শিবজয়নগর, ছাতিয়াইন, পিয়াইম, খড়কি, সাকুচাইল, মনিপুর, মোড়াকড়ি, জগদিশপুর, একতিয়ারপুর, সাতপাড়িয়াসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষ পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছেন। জেলা বাপা নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল কাইয়ুম জানান, খড়কি গাঙ্গ দিয়ে বিষাক্ত শিল্প বর্জ্য খাসটি নদীতে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় পরিবেশ বিপন্ন করছে।
শিবজয় নগর গ্রামের শামিম আহমেদ জানান, বিভিন্ন খাল দিয়ে শিল্প বর্জ্য বাহিত বিষাক্ত কালো পানি বিভিন্ন হাওর-জলাশয় হয়ে বলভদ্র নদীতে পড়ছে। লাখাই উপজেলার গদাইনগর গ্রামের কৃষক আব্দুল মতিন জানান, শৈলজুড়া খাল নিয়ে বিষাক্ত শিল্পবর্জ্যের কালো পানি সুতাং নদীতে ছড়িয়ে পড়ায় নদীর পানি বিনষ্ট হওয়া ছাড়াও নদীটি মাছ শূন্য এবং পার্শ্ববর্তী জমির ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল বলেন, হাওরসহ ফসলী জমিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রবণতা অব্যাহত থাকায় জেলার একাধিক উপজেলায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। জেলা বাপা সভাপতি অধ্যক্ষ ইকরামুল ওয়াদুদ বলেন, দীঘদিন যাবৎ হাওর ও ফসলী জমিতে শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের ফলে হাওর ও জমির আয়তন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। জেলার হাওর এলাকায় জীববৈচিত্র্য রক্ষাকল্পে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। পরিবেশ অধিদপ্তর হবিগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আক্তারুজ্জামান টুকু বলেন, এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে। এর বেশি কিছু বলতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।
জেলা প্রশাসক দেবী চন্দ বলেন, পরিকল্পিত শিল্পায়নের বিকল্প নেই। শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে পরিবেশের ভারসাম্য যাথে বিপন্ন না হয় সে ব্যাপারে সকলকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অচিরেই জেলার বিভিন্নস্থানের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠক করে শিল্প দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জেলা প্রশাসক আশাবাদ ব্যক্ত করেন।