অভিযোগের তীর কাউন্সিলর নিপুর দিকে
বালুচরে ছাত্রলীগ কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ নভেম্বর ২০২৩, ৭:৩৪:৪৬ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : সিলেট নগরীর টিবি গেট এলাকায় বাসার সামনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত ছাত্রলীগ কর্মী আরিফ আহমদ (১৯) মারা গেছেন। পরিবারের দাবি, মারধরের মামলা করায় খুন হয়েছেন তিনি। এজন্যে তারা স্থানীয় কাউন্সিলর ও সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হিরণ মাহমুদ নিপুকে দায়ী করেছেন। নিহত আরিফ আহমদ টিবি গেট এলাকার ফটিক মিয়ার ছেলে ও টিলাগড় এলাকার স্টেইট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তিনি জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি নাজমুল ইসলামের অনুসারী। সোমবার রাতে ১১টা ৫০ মিনিটে বাসার সামনে ওয়াকওয়েতে তার ওপর হামলা চালায় একদল দুর্বৃত্ত।
এ সময় আরিফকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে সড়কে ফেলে রেখে যায় তারা। তার পা, বাম হাত, বাম উরুসহ দেহের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ১২টি আঘাত করে হামলাকারীরা। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে বাঁচাতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে রাত ১টার দিকে আরিফ মারা যান। এ ঘটনায় পুলিশ রনি ও মামুন নামের দুইজনকে গ্রেফতার করেছে।
মঙ্গলবার দুপুরে সিলেট নগরীর বালুচর এলাকায় আরিফদের বাড়ি গেলে নিহত আরিফের মা আখি বেগম গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, আরিফ আহমদকে কুপিয়ে ফেলে যাওয়ার সময় তিনি দৌঁড়ে সেখানে গিয়েছিলেন। তখন তিনি দেখেছেন, সাদা পাঞ্জাবি পরে হিরণ মাহমুদ মোটরসাইকেলে উঠে চলে যাচ্ছিলেন। পরে তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায় ছেলেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় নিয়ে হাসপাতালের পথে রওনা হন। যাওয়ার পথে ছেলে তাকে বলেছে, হিরণ মাহমুদ, রনি, মামুন, হেলালসহ ১৫-২০ জন মিলে তার ওপর হামলা চালিয়েছেন।
হিরণ মাহমুদ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। নিহত আরিফ পদে না থাকলেও জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি নাজমুল ইসলামের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। আরিফ আহমেদের বাবা ফটিক মিয়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান। ক’দিন ধরে অসুস্থ থাকায় বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। ফটিক মিয়া ও আখি বেগমের পরিবারে চার ছেলে। তাদের মধ্যে সবার বড় আরিফ আহমেদ টিলাগড় এলাকার স্টেট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তেন। আঁখি বেগম বালুচর এলাকার রাজা মিয়ার কলোনিতে অন্যের রান্নাবান্নার কাজ করে সংসার চালান।
আঁখি বেগম আরো বলেন, ছেলে এক বছর আগে কলেজে ওঠার পর থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতি করত। তিনি তখন রাজনীতি করতে নিষেধ করেছিলেন। জবাবে ছেলে বলেছে, কলেজে থাকতে হলে ছাত্রলীগ করতে হয়। তা না হলে তাকে মেরে শেষ করে দেবে। এরপর তিনি জানিয়েছিলেন, এইচএসসি পাস করার পর তাকে আর কলেজে রাখবেন না।
এদিকে, আরিফের ওপর কয়েক দিন আগেও হামলা হয়েছিল। সে ঘটনা উল্লেখ করে আখি বেগম আরও বলেন, আরিফের বন্ধুর সঙ্গে অন্যদের পূর্ববিরোধ ছিল। বন্ধুকে না পেয়ে আরিফের ওপর হামলা চালানো হয়। হামলায় আরিফের বাঁ হাতের আঙুল কেটে গিয়েছিল। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরার পর এ ঘটনায় সোমবার তিনি সিলেটের শাহপরান থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। লিখিত অভিযোগ দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে তার ছেলেকে খুন করা হয়েছে।
সিলেটের শাহপরান থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মারধরের ঘটনায় আরিফের মা আঁখি বেগমের দায়ের করা অভিযোগটি সোমবার রাতেই মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। মামলায় ৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ১৫ নভেম্বর রাত ৯টার দিকে উত্তর বালুচর এলাকার ২ নম্বর মসজিদের সামনে এ হামলার ঘটনা ঘটে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে আরিফের পূর্ববিরোধ ছিল। আসামি হিসেবে বালুচর এলাকার জুনেদ, আনাছ মিয়া, কুদরত আলী, কালা মামুন, শরীফ, হেলাল ও সবুজের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
বিমানবন্দর থানা পুলিশ জানিয়েছে, হত্যায় জড়িত সন্দেহে মঙ্গলবার পুলিশ দুজনকে আটক করেছে। এরা হচ্ছেন- সোনারবাংলা এলাকার বাচ্চু মিয়ার ছেলে রনি (২১) ও বালুচর এলাকার কামাল মিয়ার ছেলে মামুন মজুমদার (২৮)। তারা দুজনেই সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সিলেট সিটি করপোরেশনের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের নতুন কাউন্সিলর হিরন মাহমুদ নিপুর কর্মী।
অপরদিকে গতকাল মঙ্গলবার আরিফের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান মো. শামসুল ইসলাম গণামধ্যমকে জানিয়েছেন, নিহত আরিফের দুই পায়ের ঊরুর পেছনের দিকে, গোড়ালিতে ও হাতে এসব আঘাত লেগেছে। শরীরে ২০টি সুচালো ও ধারালো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এতে রক্তনালি কেটে যাওয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া আরিফের শরীরে আরও তিনটি হালকা জখমের চিহ্ন রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হবে বলে জানান তিনি।
সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম বলেন, আটক রনি ও মামুন ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিরণ মাহমুদের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। তাঁরা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এলাকায় তারা বখাটে হিসেবে পরিচিত। তিনি বলেন, পূর্বপরিকল্পিতভাবেই আরিফ আহমেদকে খুন করা হয়েছে। তার শরীরে ১৬-১৭টি কোপ ও ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। তিনি বলেন, আরিফ হত্যাকান্ডের দলীয় কর্মসূচির ব্যাপারে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
অন্যদিকে আরিফ হত্যার ঘটনাটি ঘটেছে বিমানবন্দর থানা এলাকায়। তবে শাহপরান থানায় যে অভিযোগটি দিয়েছিলেন সেটি নথিভুক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শাহপরান থানার ওসি আবুল খায়ের। এ ঘটনা বিমানবন্দর থানা এলাকায় হওয়ায় ওই থানায় মামলা করার কথা আছে।
বিমানবন্দর থানার ওসি মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন বলেন, হত্যাকা-ের ঘটনায় রাত ১০টা পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি। এ ঘটনায় দুজনকে আটক করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
মহানগর পুলিশের উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ বলেছেন, ‘অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে আরিফের উপর হামলা করা হয়। রাতেই তিনি মারা যান। খুনে জড়িত সন্দেহে দুজনকে আটক করা হয়েছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে।’