‘তৃতীয় লিঙ্গ’ পরিচয়ে ভোটার হলেও ‘জনপ্রতিনিধি’ হতে মাঠে নেই হিজড়ারা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ২:৪১:২৯ অপরাহ্ন
নূর আহমদ :
‘তৃতীয় লিঙ্গ’ পরিচয়ে ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলেও ‘জনপ্রতিনিধি’ হওয়ার জন্য মাঠে নেই হিজড়ারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এজন্য হিজড়াদের অসচেতনতা, বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়াসহ নানা কারণ রয়েছে। আবার হিজড়ারা দাবি করছে, সরকারি স্বীকৃতি পেলেও এখনো সামাজিক স্বীকৃতি আসেনি তাদের। সম্প্রতি সিলেট অঞ্চলের হিজড়া বা লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করছেন, এমন ব্যক্তি ও সংগঠন সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জানা যায়, হিজড়া পরিচয়ে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রধান দাবি ছিল স্বীকৃতির। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ২০১৩ সালে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। গেজেটে বলা হয়, ‘সরকার বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীকে হিজড়া লিঙ্গ (ঐরলৎধ) হিসাবে চিহ্নিত করিয়া স্বীকৃত প্রদান করিল।’
এদিকে স্বীকৃতি পেলেও দেশের বিভিন্ন অফিস-আদালত, দপ্তর, অধিদপ্তর ও সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর নিজস্ব বিধির পরিবর্তন না আনায় হিজড়া জনগোষ্ঠী আলাদা লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এর মধ্যে সরকার ভোটার তালিকায় হিজড়া পরিচয়ে তাদের নাগরিকত্বের সুযোগ নিশ্চিত করে দেয়। ভোটার নিবন্ধন সার্ভারে পুরুষ-মহিলার পাশাপাশি ‘হিজড়া’ অপশন রাখা হয়। কিন্তু দেখা গেছে, আগে যারা পুরুষ বা মহিলা পরিচয়ে ভোটার হয়েছেন, তারা ভোটার তালিকায় ‘হিজড়া’ পরিচয়ে নিজেদের স্থানান্তর করছেন না। আবার কেউ কেউ ইচ্ছে করে এই পরিচয় দিচ্ছেন না। ফলে স্থানীয় কিংবা জাতীয় নির্বাচনে সাধারণ নারী-পুরুষের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকছেন না হিজড়ারা।
বিভাগীয় পরিসংখ্যান অফিস সিলেট কার্যালয় জানায়, সর্বশেষ ২০২২ সালের প্রাথমিক পরিসংখ্যানে সিলেট বিভাগের চার জেলায় জনসংখ্যা হিসেবে ৮৪০ জন ‘হিজড়া’ হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন। এর মধ্যে সিলেট জেলায় ২৮৪ জন, সুনামগঞ্জে ২২৩ জন, হবিগঞ্জে ১৮৯ জন এবং মৌলভীবাজারে ১৪৪ জন হিজড়া নিবন্ধিত হয়েছেন।
সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় জানায়, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট বিভাগের ১৯ আসনে সর্বমোট ভোটার রয়েছেন ৭৮ লাখ ৫৪ হাজার ৫০৭ জন। এর মধ্যে নারী-পুরুষের সঙ্গে ৪৬ জন হিজড়া ভোটার রয়েছেন। জেলাওয়ারী পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জে ১৩ জন করে এবং মৌলভীবাজারে ৭ জন হিজড়া ভোটার রয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনসংখ্যা হিসেবে ৮৪০ জন নিবন্ধিত হলেও হিজড়া পরিচয়ে অনেকেই ভোটার হননি। তারা নারী কিংবা পুরুষ পরিচয়ে নিজ নিজ এলাকায় ভোটার হয়েছে।
একাধিক সূত্র জানায়, সিলেটে বিপুলসংখ্যক হিজড়া রয়েছেন। সিলেট বিভাগের চার জেলায় তারা বেশ সংঘটিত। এর মধ্যে বাবলী হিজড়া হবিগঞ্জ, কালা হিজড়া সুনামগঞ্জ ও রত্না হিজড়া মৌলভীবাজারে হিজড়াদের ‘গুরুমা’র দায়িত্ব পালন করেন। সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকার শাহপরান (রহ:) থানায় লিপি হিজড়া, দক্ষিণ সুরমা থানায় খালিক হিজড়া, এয়ারপোর্ট থানায় রানা হিজড়া এবং কতোয়ালী ও জালালাবাদ থানা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন আলেয়া হিজড়া। তাদের সকলের গুরুমা হলেন সুন্দরী হিজড়া। তিনিই পুরো সিলেট বিভাগের হিজড়াদের নিয়ন্ত্রণ করেন।
সিলেটে অবস্থনরত হিজড়াদের প্রকৃত সংখ্যা প্রথমে বলতে চাননি ‘গুরুমা’ সুন্দরী হিজড়া। তার দাবি, সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকায় চার-পাঁচশো’ হিজড়া রয়েছেন। কিন্তু কেউ জানতে চাইলে তিনি ২০০ থেকে ২৫০ জনের সংখ্যা দেন। কারণ এরা নারী অথবা পুরুষ নামে ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত রয়েছেন।
সুন্দরী হিজড়া বলেন, তার নিজের ভোট সুন্দরী বেগম নামে তালিকাভুক্ত। সরকার যে ভোটার তালিকায় হিজড়া হিসেবে তালিকভুক্তির সুযোগ দিয়েছে, সেটা তার জানা নেই। তিনি আরো বলেন, সরকারিভাবে প্রতিবছর কিছুসংখ্যক হিজড়াকে ট্রেনিং দেওয়া হয়। ভোটার তালিকায় যাদের নাম আছে, তাদেরকে ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে হিজড়ারা বেশ সংঘটিত ও মূল্যায়িত। এই সুযোগে সীমান্তবর্তী সিলেটের অনেক হিজড়া ভারতে চলে যান, আবার সেখানকার বাংলাভাষাভাষী অনেক হিজড়া বাংলাদেশে চলে আসেন। হিজড়াদের প্রকৃত সংখ্যা বলতে না পারার কারণ এটাই কিনা জানতে চাইলে সুন্দরী হিজড়া বলেন, যেভাবে বলা হচ্ছে সেভাবে না, তবে আমাদের ঘরবাড়ি ভারতে রয়েছে। পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই মাঝেমাঝে যাওয়া-আসা করতে পারি।
সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সুযোগের অভাবে হিজড়ারা ভিক্ষাবৃত্তি ও নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের নিয়ে ভাবতে হবে। শুধু কাগজপত্রে তাদের স্বীকৃতি দিলে চলবে না। প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করে তাদেরকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলেই ধীরে ধীরে এদের জন্য জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
হিজড়াদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘হিজড়া যুব কল্যাণ সংস্থার’ সভাপতি মিস সুক্তাও একজন হিজড়া। তিনি ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া ও ভোটার তালিকায় হিজড়া হিসেবে অন্তর্ভুক্তি এবং নির্বাচনে হিজড়া হিসেবে ভোটে দাড়াঁনোর সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে অবগত। কিন্তু তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা এখনো সামাজিক স্বীকৃতি পাইনি। এতো এতো সুবিধা পেলে আমি নিজেও একদিন ‘ভোটে দাঁড়াবো।’
সিলেটে হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে ‘আশার আলো যুব কল্যাণ সংঘ’। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মাহফুজ আলম বলেন, রাষ্ট্রের কাছ থেকে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে কোনো সুবিধা নিতে হলে ক্ষেত্রবিশেষ পুরুষ, আবার কখনও নারী পরিচয়ে নিতে হচ্ছে। সুতরাং এই স্বীকৃতি যেমন হিজড়াদের কোনো কাজে আসছে না, তেমন হিজড়ারাও এই স্বীকৃতি নিয়ে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে না। মাহফুজ আলম আরও বলেন, সবাই মিলে কাজ করলে একদিন হিজড়ারা জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংস্থায় নেতৃত্ব দিবে, ভোটের মাঠেও খেলবে।
সিলেট জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠান) মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, ২০১৩ সাল থেকে প্রতিবছর ৫০জন হিজড়াকে মনোসামাজিক কাউন্সিলিং, টেইলারিং, মোটর ড্রাইভিংসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা পুনরায় পুরনো কাজে চলে যায়। তবুও তাদের স্বাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বিভাগীয় পরিসংখ্যান অফিস, সিলেটের যুগ্ম পরিচালক মো. শাহাবুদ্দীন সরকার বলেন, বাংলাদেশের কোনো নাগরিকই এখন হিসেবের বাইরে নয়। হিজড়া জনগোষ্ঠীও হিসেবের মধ্যে চলে আসছে। তবে অনেকেই হিজড়া পরিচয়টি গোপন করতে চায়।
আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস, সিলেট-এর আঞ্চলিক কর্মকর্তা মো. আব্দুল হালিম খান বলেন, সিলেট অঞ্চলের ৪৬ জন ভোটার হিজড়া পরিচয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে তারা এই পরিচয়ে ভোট দিতে পারবেন। এটা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি। চাইলে তারা নিজস্ব পরিচয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নিতে পারে।
সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমদ ছিদ্দীকী এনডিসি বলেন, অবহেলা-অবজ্ঞায় থাকা হিজড়া জনগোষ্ঠী আমাদের সমাজেরই অংশ। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নিজস্ব পরিচয়ে তাদের ভোটার হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের বিভিন্ন অফিস-আদালত, দপ্তর-অধিদপ্তর ও সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর নিজস্ব বিধির পরিবর্তন আসবে। হিজড়া জনগোষ্ঠীকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।