বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসা ও ব্রিগেডিয়ার মালিক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ২:৪১:৪১ অপরাহ্ন
সেলিম আউয়াল
চিকিৎসা জগতে আমাদের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ব্রিগেডিয়ার ডা. মো. আবদুল মালিক (অব.) চলে গেলেন। ৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ঢাকায় ইন্তেকাল করেছেন। পরের দিন ৬ ডিসেম্বর বাদ আসর নামাজে জানাজাশেষে সিলেটে তাদের পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয়। তিনি বেশ কিছুদিন থেকে বার্ধ্যক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।
ব্রিগেডিয়ার মালিক হৃদরোগ চিকিৎসায় এদেশে বিপ্লব সাধন করেছেন। বাংলাদেশে হৃদরোগের চিকিৎসার অগ্রগতির কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭০ সালে শুধুমাত্র কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে আমি একাই ছিলাম। অন্যান্য যাঁরা ছিলেন তাঁরা মেডিসিনের সঙ্গে কার্ডিওলজির প্র্যাকটিস করতেন। আল্লাহর মেহেরবানিতে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৩০০ কার্ডিওলজিস্ট এবং কার্ডিয়াক সার্জন রয়েছেন। তাঁরা বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এবং বিদেশে কর্মরত থেকে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আশা করি, ভবিষ্যতে আরও অনেক দক্ষ এবং বিশেষজ্ঞ কার্ডিওলজিস্ট এবং কার্ডিয়াক সার্জন গড়ে ওঠবে, যারা সমগ্র দেশ ও জাতিকে আরও উন্নত সেবা প্রদান করতে সক্ষম হবে।’
বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসার এই উন্নতি ব্রিগেডিয়ার সাহেবের হাত দিয়েই হয়েছে। জনগণের মধ্যে হৃদরোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে তার উদ্যোগে পথচলা শুরু করেছিলো ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ। আজ এটি বিশাল একটি প্রতিষ্ঠান। সারাদেশে সংগঠনের এফিলিয়েটেড ২৬টি শাখা রয়েছে। ফাউন্ডেশনের একটি প্রকল্প হচ্ছে-‘ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট’ Ñএটি দেশের সবচেয়ে বড়ো হৃদরোগ হাসপাতাল। ব্রিগেডিয়ার মালিক উল্লেখ করেছেন, ‘সরকার এই হাসপাতালকে ইনস্টিটিউটের মর্যাদা দিয়েছেন। একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক বিভিন্ন একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এই একাডেমিক কাউন্সিলে রয়েছেন হাসপাতালে কর্মরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ। চিকিৎসা ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য এখানে নিয়মিতভাবে ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান ও প্যারামেডিকসদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এবং বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে এই হাসপাতালে এমডি (কার্ডিওলজি), এমএস (কার্ডিওথোরাসিক সার্জারি) কোর্স চালু রয়েছে। যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে; বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, সার্জন, টেকনিশিয়ান, নার্সদের মধ্যে অনেকে হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।’
ব্রিগেডিয়ার (অব.) মো. আবদুল মালিকের জন্ম ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১ ডিসেম্বর সিলেট সদর উপজেলার কুচাই ইউনিয়নের পশ্চিমভাগ নোয়াগাঁও গ্রামে। নিজের গ্রামের বর্ণনা দিয়েছেন মো.আবদুল মালিক ‘গ্রামটা সিলেট শহর থেকে চার মাইল পূর্ব দিকে অবস্থিত। সুরমা নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা ছায়া সুশীতল এই গ্রামটাতেই অনাবিল আনন্দের মধ্য দিয়ে আমার শৈশবের দিনগুলো কেটেছে। গ্রামের চারিদিকে সবুজ আর সবুজ, যেন কেউ সবুজের গালিচা পেতে রেখেছে। সেই যে কবির ভাষায় ছবির মতো আমার গ্রামখানি। বেশ বড় ছিল আমাদের গ্রামের বাড়িটা। তখনকার দিনে একই ঘরের ভেতরে সব থাকতো না। বাইরের লোকদের বসার জন্য বাড়ির সামনের দিকে ঘর ছিল, যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘টঙ্গী’ বলা হতো। আত্মীয় স্বজনদের জন্য ভিন্ন ঘর ছিল, রান্না ঘর, অন্যান্য ঘর সব আলাদা-আলাদা ছিল। সবচেয়ে ভেতরে ছিল পরিবারের সদস্যদের জন্য ঘর। আমাদের বাড়ির সামনে এবং পেছনে পুকুর এবং বিস্তীর্ণ মাঠ ছিল। সেই পুকুরে গোসল করা আর সাঁতার কাটার মজাটাই ছিল অন্য রকম। সমবয়সীরা দল বেঁেধ সাঁতার কাটতাম। আর বিস্তীর্ণ মাঠে খেলাধুলার আনন্দের তো কোন তুলনাই ছিল না।’
তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর শৈশবের, ‘আমার শৈশবের সেই সময়ে কোন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। তাই বিদ্যুতের ঝলকানি আলো থেকে আমরা ছিলাম বঞ্চিত। মূলত হ্যারিকেন, লন্ঠন জ¦ালিয়েই আমরা অন্ধকার দূর করতাম। হ্যারিকেনের সেই স্বল্প আলোতে আমরা পড়ালেখা, খাওয়া-দাওয়া সবই করতাম। সেই সময়ে গ্রামে কোন রেডিও, টেলিভিশন ছিল না। অবশ্য ভালোই ছিল, যন্ত্রগুলো না থাকাতে আমরা এখনকার মতো যান্ত্রিক সময় কাটাইনি।
আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই মিলে মমতায় জড়াজড়ি করে থাকতাম। সবাই সবার প্রতি একটা আত্মীক টান অনুভব করতাম। গ্রামের মানুষগুলোর মধ্যে অদ্ভুত একতা বিরাজ করতো। পুরো গ্রাম জুড়ে মনে হতো একটা পরিবার। অথচ এখনতো একই ছাদের নিচে বাস করেও কেউ কারো খবর রাখে না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।’
ব্রিগেডিয়ার আবদুল মালিক ‘জীবনের কিছু কথা’ শিরোনামে ১৫৪ পৃষ্ঠার আত্মজীবনীটি লিখেছেন। নিজের জীবনকথার বাইরেও ‘জীবন ও ধর্মদর্শন’, ‘শিক্ষা এবং হৃদরোগ সম্পর্কে কিছু আলোচনা’ শিরোনামে আলাদা তিনটি প্রবন্ধ রয়েছে এতে। বইটি ঢাকার ধানমন্ডির সাইন্টিফিক মিডিয়া সার্ভিসেস থেকে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে বের হয়। জীবনের নানা বাঁকের কথা লিখেছেন তিনি।
আবদুল মালিক যখন ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্র, তিনি ১৯৪৯-এ ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হন। সেই সময়ের ঢাকার একটি ছবি আমরা দেখতে পাই তার জবানিতে ‘রাস্তাঘাটে কদাচিৎ মেয়েদের দেখা যেত। ইডেন কলেজের মেয়েরা তখন পর্দা ঘেরা টাঙ্গায় (এক ধরনের ঘোড়ার গাড়ি) চড়ে আমাদের হোস্টেলের কাছের রাস্তা দিয়ে কলেজে যেত। ভালো হোটেল বলতে সে সময় শাহবাগ হোটেলকেই বোঝাতো, যেটা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়। আর মজার ব্যাপার হলো, ঢাকা শহরে তিন-চার তলা বিল্ডিংই ছিল সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং, যা এখনকার সময়ে সবচেয়ে নিচু বিল্ডিং। সে সময় নিয়ন বাতির ঝলকানিও ছিল না। আমার মনে রয়েছে ওই সময়ে একদিন ইরানের শাহ আমাদের দেশে আসলেন। আমরা তাঁকে দেখার জন্য তখনকার বিমানবন্দরে (তেজগাঁও বিমানবন্দর) যাই। সে সময় ওই সব এলাকা গ্রামের মতো ছিল, চারিদিকে গাছগাছড়ায় পরিপূর্ণ, রাস্তা-ঘাট ছিল অপ্রশস্ত। আসলে এখনকার ঢাকা আর তখনকার ঢাকার মধ্যে কত যে তফাৎ তা বোঝানো সত্যিই মুশকিল।’
বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে গঠিত তদন্ত কমিশনের সামনে আবদুল মালিক সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ‘আমি মেডিকেল কলেজে পড়াকালে ভাষা আন্দোলন হয়। ভাষা আন্দোলনে মেডিকেল কলেজের প্রায় সব ছাত্রেরই কম-বেশি ভূমিকা রয়েছে। ১৯৫২ সালে মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আমি। ভাষা আন্দোলনে গোলাগুলির পরে সরকার ঢাকা হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং ওই কমিটিতে আমাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। আমাকেও সাক্ষী হিসেবে ডাকা হয় এবং বিচারপতির নিকট সাক্ষ্য দেই। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় ‘গুলি বর্ষণ যুক্তিসঙ্গত ছিল কি না। উত্তরে আমি বলেছিলাম ‘গুলি চালানোর মতো কোন অবস্থা সৃষ্টি হয়নি; সুতরাং এটি একেবারে যুক্তিসঙ্গত নয়। আমার এই বক্তব্য গ্রহণ করা হয়নি, রিপোর্টে অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি। শুধুমাত্র তাদের মনোপুত সাক্ষ্যগুলোই রেকর্ড করা হয়।’
ব্রিগেডিয়ার মালিক সম্পর্কে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও চিকিৎসক ডা. মোড়ল নজরুল ইসলামের মন্তব্য দিয়ে লেখার সমাপ্তি টানতে চাই। তিনি লিখেছেন-‘দেশে হৃদরোগ চিকিৎসা আন্দোলনের পথিকৃৎ খ্যাতিমান হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) এ মালিক শুধু জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছেন তাই নয়, তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। অধ্যাপক মালিকের জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে হার্টের বাইপাস সার্জারিসহ সব ধরনের হার্ট সার্জারি, এনজিওগ্রাম-এনজিওপ্লাস্টিসহ হার্টের আধুনিক চিকিৎসার সকল সুযোগ এখন দেশেই সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সাশ্রয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য ও ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে তিনি দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং জনগণের স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নেও তিনি অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন।’
লেখক : গল্পকার, প্রবন্ধিক, সংগঠক