৫২ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি হেমু গণহত্যার
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ৫:১২:৩২ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম :
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুরের করিছ নদীর পাশের একটি গর্তে সমাহিত আছেন পাকিস্তানী সেনাদের হাতে নিহত ১৭ জন শহীদ চা শ্রমিক। কিন্তু, স্বাধীনতার ৫২ বছরেও এই গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সতের নয়, এখানে ১৬২ জন চা শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, করিছ নদী থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটি সবুজ বাগান। নাম খান চা বাগান। এই বাগানের মালিক ছিলেন আতাহার আলী খান। তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দা। সেই চা বাগানের সবুজ চা পাতার ভেতরে টকটকে লাল একটি ইতিহাস অনেকটা বিস্মৃতির আড়ালেই রয়ে গেল যুগ যুগ ধরে।
দিনটি ছিলো ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। ৫ নম্বর সেক্টরের হেমুর সড়কটি ধরেই ভারতের সীমান্ত। যুদ্ধের সময় আরো বেশ কিছু কারণে পাকিস্তানীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় তারা ভারী অস্ত্র নিয়ে হরিপুরের আশপাশে অবস্থান নেয়। আবার একটা পর্যায়ে তাদের পরাজয়টাও অনিবার্য হয়ে আসে। বিষয়টি তাদের বুঝতে আর বাকি থাকলো না। এজন্য তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। নির্বিচারে হত্যাসহ নানা রকম পৈশাবিক নির্যাতনে মেতে ওঠে হেমুর আশপাশ এলাকায়।
হেমুর চারপাশে যুদ্ধের ভয়াবহতা নিরীহ চা শ্রমিকদের জীবনের প্রতি মায়া বাড়ায়। এক পর্যায়ে ভারতে পালিয়ে যাবার সংকল্প করে তারা। ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে রওয়ানা করে জাফলং অভিমুখে। স্থানীয় রাজাকাররা সেই খবর পৌঁছে দেয় পাকিস্তানীদের কাছে। করিছ নদীর উপর বেইলী ব্রীজের কাছে আসা মাত্র স্থানীয় শ্রমিকদের ঘেরাও করে ফেলে পাকিস্তানীরা।
বহু শ্রমিকের মধ্যে যুবক দেখে ১৭ জনকে আটকে বাকিদের বাগানে ফিরে যেতে বলে। তারপর ঘটে সেই নির্মমতা। সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয় এক সাথে। সেদিনের সেই হত্যার সাক্ষী হয়ে আজো বয়ে যাচ্ছে করছ নদীটি। আরো সাক্ষী হয়ে আছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ আশপাশের কিছু মানুষ। যারা এখনো সেই ঘটনার জন্য আফসোস করেন। সেই সাথে মর্মাহত হন গণকবরটি পড়ে থাকায়, অযতœ অবহেলায়।
তার মধ্যে একজন কালা মিয়া। বয়স ৬৫ ছুঁই ছুঁই। হেমু ভাটপাড়ার মৃত আকু মিয়ার ছেলে কালা মিয়া পেশায় একজন কৃষক। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন সেই গণকবরে ছুটে যাই। এসময় জাল হাতে থাকা কালা মিয়া সাংবাদিক পরিচয় শুনে এগিয়ে আসেন। বয়সে বৃদ্ধ মনে হলেও সুঠাম দেহের মানুষটি নিজে থেকেই বলছিলেন, ‘আমি বাগানের কয়েকজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছি।’ যেদিন শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা করা হয় তখন কালা মিয়া কিশোর। হঠাৎ সেদিন গুলির শব্দ শুনে তিনিও দৌড়ে প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। সেই দৌড় পাকিস্তানীদের চোখে পড়ে যায়। পরে তাকেও খুঁজেছিলো পাকিস্তানীরা।
‘কয়েক বছর আগেও ভারি বৃষ্টিপাত হলে মাথার খুলি, হাঁড় ভেসে উঠতো বিশাল সেই গর্ত থেকে। এখনো খনন করলে পাওয়া যাবে’-কথাগুলো বলছিলেন হেমু গ্রামের লেখক, কবি মোহাম্মদ জোয়াহিদ। তিনি গণকবর দেখিয়ে বলছিলেন- ‘আমরা গণকবরের পাশ দিয়ে গেলে কান্নার শব্দ শুনতে পাই। সেই কান্নার পাশে কেউ দাঁড়ালো না বায়ান্ন বছরেও।’
হেমু গ্রামে চা শ্রমিকদের নির্মমভাবে হত্যার কথা আজো ভুলেননি ফতেহপুর ইউনিয়নের বাগরখাল গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ছলিম উল্লাহ। লেখক মোহাম্মদ জোয়াহিদ আমাদের নিয়ে যান হেমুর গণহত্যার মাটি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সেইগ্রামে, ছলিমউল্লার কাছে। ছায়াঘেরা বাড়ির বারান্দায় বসে শুনছিলাম যুদ্ধদিনের কথা। একপর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই মুক্তিযোদ্ধা জানান, ‘৫২ বছর হয়ে গেছে। অথচ আজ পর্যন্ত সেই হেমুর গণহত্যার জায়গাটি রক্ষার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘যারা শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মা শান্তি পেতো, এই স্মৃতি রক্ষা করা হলে। বৃহত্তর জৈন্তাপুরের মধ্যে বড় গণহত্যা এটি। অথচ আজ পর্যন্ত কেন কেউ এগিয়ে আসছেনা, বিষয়টা আমাদের আহত করে।’
হেমুর করিছ নদীর পাশের এই গণহত্যার ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই কারো কাছে। এমনকি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেও পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় তরুণ গবেষক আব্দুল হাই আল হাদি’র তথ্যের উপর ভর করেই এই গণহত্যার কিছু অজানা তথ্যের সন্ধান পাওয়া।
যোগাযোগ করা হলে জৈন্তাপুর উপজেলা মুক্তিযুদ্ধ কমান্ডের ভারপ্রাপ্ত কমান্ড যাদবময় বিশ্বাসও হতাশ করেন। তাঁর কাছে এব্যাপারে কোনো তথ্য নেই বলে জানান।
তরুণ গবেষক আব্দুল হাই আল হাদি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের দলিলাদি ঘেঁটে গণহত্যার জায়গাটি আবিষ্কার করি। এটি কেন সংরক্ষণ করা গেল না, তা ৫২ বছর ধরে অজানাই রয়ে গেলো।’
এ প্রসঙ্গে ৫ নম্বর সেক্টরের আরেক মুক্তিযোদ্ধা, সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট জেলার আহবায়ক মো. লুৎফুর রহমান লেবু জানান, এ ঘটনা সম্পর্কে আমিও অবগত। কিন্তু সংরক্ষণ না করায় নতুন প্রজন্ম একটি ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার।
খান চা বাগানের শ্রমিকদের হত্যাটি উঠে আসে বিশিষ্ট লেখক গবেষক তাজুল মোহাম্মদ এর ‘সিলেটে গণহত্যা’ গ্রন্থে। সেই গ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠায় তিনি ১৭ জন তরুণ চা শ্রমিককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার বর্ণনা দিয়েছেন। একইদিন হেমু গ্রামে পাক বোমারু বিমানের সেলিংয়ে নিহত আরো ১১ জনের নামও উল্লেখ করেন সেখানে।
সেই হত্যার শিকার ১৭ জনের মধ্যে ১৩ জনের নাম পাওয়া যায় তাজুল মোহাম্মদের গ্রন্থে। তারা হলেন-বংশী মাঝি, নন্দলাল বাড়াই, অগ্নু করুয়া, ছিকরা করুয়া, মিকরা করুয়া, বুধু সাওতাল, আকালী ভুইয়া, পুযুয়া করুয়া, ছ¤œা করুয়া, রামচান্দ করুয়া, হীরালাল করুয়া, মংরু কর্মকার ও ভীম করুয়া। এছাড়া ওইদিন হেমু গ্রামে পাক বোমারু বিমানের সেলিংয়ে আরো ১১ জন মানুষের মৃত্যুর বর্ণনাও রয়েছে সেই সিলেটে গণহত্যায়।