তৃণমূলে নারী নেতৃত্বের সংগ্রামে মিনা বেগম
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ৫:২৩:৩৫ অপরাহ্ন
আনাস হাবিব কলিন্স :
অগ্রহায়ণের এক দুপুরে সিলেট নগরী থেকে বিশ্বনাথ উপজেলার আগনশাসন গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা। উদ্দেশ্য অপরাজিতা নেটওয়ার্কের সদস্য সংগ্রামী নারী মোছা. মিনা বেগমের সাথে সাক্ষাৎ। উপজেলা সদর হয়ে নকিখালি বাজারে পৌঁছে মিনা বেগমের বাড়ির রাস্তা জিজ্ঞেস করতেই লোকজন জানান ‘মিনা বেগমের’ বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। স্থানীয়রা দেখিয়ে দেন এলাকার সুপরিচিত আগনশাসন গ্রামের মিনা বেগমের বাড়ির দিকে সরু রাস্তাটি।
এক পর্যায়ে কথা হয় পরাজয় না মানা অপরাজিতা মিনা বেগমের সাথে। তিনি জানালেন, একাধারে তিন মেয়াদে ছিলেন রামপাশা ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নির্বাচিত সদস্য। ওই সময়ে তিনি এলাকার জনসাধারণের উন্নয়নের পাশাপাশি নারী উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সংরক্ষিত ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি হিসেবে শিকার হয়েছেন নানা প্রতিবন্ধকতার। সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য হিসেবে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রতিবাদ করেছেন। পরিষদের ন্যায্য পাওনা আদায় করতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। জীবনে অনেকবার প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েও ভেঙ্গে পড়েননি তিনি। সততা আর সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেছেন সমস্ত ঝড়ঝাপ্টা। বিনিময়ে অর্জন করেছেন সম্মান ও খ্যাতি।
মিনা বেগম তার এগিয়ে যাওয়ার গল্প জানান, এক সময় তিনি গ্রামের সাধারণ গৃহবধূ ছিলেন। অপরাজিতা নেটওয়ার্কে জড়িত হওয়ার পর প্রেরণা পেয়েছেন। ওই নেটওয়ার্ক থেকে তিনি জানতে পেরেছেন নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি। প্রান্তিক নারীদের এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টার বিষয়টি তিনি বুঝতে পেরেই এগিয়ে আসেন স্থানীয় সরকারের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রচেষ্টায়। তিনি এ প্রেরণা থেকেই পর পর তিনবার সংরক্ষিত ইউপি সদস্য হিসেবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন । অপরাজিতা প্রকল্পের মাধ্যমে জানতে পারেন নারীরা শুধু সংরক্ষিত আসন নয় সাধারণ আসনেও নির্বাচন করা যায়।
মিনা বেগম অনুধাবন করলেন সংরক্ষিত ইউপি সদস্য হিসেবে এলাকার এবং নারীর ক্ষমতায়নে যতটুকু ভূমিকা রেখেছি, তার চেয়ে বেশি সম্ভব সাধারণ সদস্য নির্বাচিত হলে। এই উপলব্ধি থেকে বিগত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রামপাশা ইউনিয়ন পরিষদের ৯নং ওয়ার্ডে সাধারণ আসনের প্রার্থী হন তিনি। তালা মার্ক নিয়ে সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। এ প্রসঙ্গে আক্ষেপ করে মিনা বেগম জানান, সাধারণ ওয়ার্ডে নির্বাচন করতে গিয়ে অনেক অপপ্রচারের শিকার হতে হয়েছে। অনেক পুরুষের তীর্যক মন্তব্য তাকে পীড়া দিলেও তিনি তা গায়ে মাখেননি। মিনা জানান, সাধারণ সদস্য পদে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে পারলেও আমি কেন পারব না? প্রচন্ড মনোবল আর ধৈর্য দিয়ে সকল প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে বিজয় নিশান ওড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।
চার সন্তানের জননী ওই নারী জানান, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনও অনেক পুরুষ নারীর অগ্রগতিকে ভালো চোখে নিতে পারছেন না। আবার অনেক পুরুষের চিন্তাচেতনা ভিন্ন বলেও মন্তব্য করেন। অপরাজিতা প্রকল্পের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ তার চিন্তাচেতনাকে প্রসারিত করেছে বলে জানান তিনি। নারীর ক্ষমতায়নে জড়িত হলে তার প্রয়াত স্বামী চেরাগ আলীসহ পরিবারের সদস্যদের সমর্থনের কারণেই তিনি আজ এ পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। তিনি জানান, জয়-পরাজয় বড় কথা নয়, নির্বাচনে অংশ নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে নারী নেতৃত্বকে এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি লড়ছেন। বেঁচে থাকলে আগামীতেও লড়বেন। এলাকাবাসীর অকুন্ঠ ভালোবাসা কাক্সিক্ষত স্থানে নিয়ে যাবে বলেও আশাবাদী এই প্রত্যয়ী নারী।
মিনা বেগম নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, অপরাজিতা নেটওয়ার্কের সদস্য হিসেবে বুঝতে পেরেছি, দেশের ইতিবাচক অর্জনে নারীকে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হলে নারীর অগ্রযাত্রা আরো ত্বরান্বিত হবে। এতে জেন্ডার বৈষম্য দূরীভূত হবে। এর সুফল ভোগ করবে এলাকাবাসী। তাই তিনি সকল স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে নারীসমাজকে আরো সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশ্বনাথ উপজেলায় অপরাজিতার সক্রিয় কর্মকান্ড নারী জাগরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এ যাত্রা অব্যাহত থাকলে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে গোটা বিশ্বনাথ একটি মডেল হিসেবে পরিণত হবে।
অপরাজিতা প্রকল্পের মাধ্যমে নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুফল মিনার জীবনে বয়ে এনেছে। এতে লাভবানও হচ্ছেন এলাকার নারীগণ।
মিনা বেগমের এগিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে সিলেট জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহিনা আক্তার বলেন, তৃণমূলে নারীর অগ্রযাত্রায় এটি সাহসী পদক্ষেপ। এভাবে নারীরা এগিয়ে এলে সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।