বায়ান্ন বছর ধরে কচুরিপানার নিচে লালমাটিয়ার গণকবর
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৩:১৯ অপরাহ্ন

আহমাদ সেলিম :
সিলেট থেকে আনুমানিক তিন কিলোমিটার দূরে লালমাটিয়া এলাকা। এই লালমাটিয়ায় কচুরিপনার নিচে পড়ে আছে যুদ্ধদিনের স্মৃতিজড়ানো একটি বৃহৎ গণকবর। যা দেশ স্বাধীনের বায়ান্ন বছরেও সংরক্ষণ করা গেলো না। এই না পারার ব্যর্থতায় নতুন প্রজন্মের অনেকেই সেই গণকবরের ইতিহাস জানে না।
সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের লালমাটিয়ার পাশে গোটাটিকর ষাটঘর নামে একটি গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দা লাল মিয়ার বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি। যুদ্ধের সময় তিনি সিলেট শহরের লামাবাজার এলাকায় বসবাসকারী নূরউদ্দিন নামে একজন স্বনামধন্য ঠিকাদারের জিপগাড়ি চালাতেন। যেদিন গাড়িতে যাওয়া হতো না, সেদিন তিনি গ্রামের পাশের জমিতে হালচাষ করতেন। হাওরে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকদিন পাকিস্তানী মিলিটারীর লোকজন তাকে কোদাল দিয়ে মাটি খনন করায়। তিনি ছাড়া আরো কয়েকজনকেও তারা সেই কাজে ব্যবহার করতো। তারপর সেই গর্তের মধ্যে চোখবাঁধা, হাতবাঁধা মানুষগুলোকে গুলিতে হত্যা করে পুঁতে ফেলা হতো। যুদ্ধদিনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি সংরক্ষণ না করায় জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও আফসোস গেলোনা লাল মিয়ার। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় এই জায়গার নাম ছিলো সোনাপতির মোড়া। পাকিস্তানীরা যখন সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজনকে বেঁধে এনে এখানে হত্যা করে, তখন আশপাশ এলাকা রক্তে লাল ছিলো। সেই থেকে এই জায়গার নাম লালমাটি। যুদ্ধের সময় রেডিও তে যখন খবর শুনতাম, তখনও জায়গাটির নাম লালমাটি বলতে শুনেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত জায়গাটির প্রতি সম্মান জানানো হলোনা।’
এই গ্রামের বাসিন্দা জুয়েল মিয়া। সরেজমিন লালমাটিয়া গেলে দেখা হয় ষাটোর্ধ্ব এই মানুষটির সাথে। স্মৃতিচারণের শুরুতেই তাঁর চোখ ভিজে যায়। বেশ কিছু সময় কাঁদছিলেন তিনি। চোখ মুছে জুয়েল মিয়া জানান, ‘প্রায় প্রতিদিন লালমাটিয়ায় মানুষকে হত্যা করতো পাকিস্তানীরা। আমি তখন ছাগল চরাতাম। বনের ঝোঁপে লুকিয়ে দেখতাম তাদের নিষ্টুরতা। তারা চোখ, মুখ বেঁধে মানুষজনকে গাড়ি করে নিয়ে আসতো। অনেক সময় মানুষ না পেলে বোমা মেরে বড় গর্ত তৈরী করতো। সেই গর্তে নারী পুরুষদের পুঁতে রাখতো। তবে সরকার কিছু না করলেও প্রতিবছর বিজয় দিবসে আমি গণকবরের জায়গাটিতে লালসবুজ পতাকা উড়াই।’
প্রবীণ লাল মিয়া আরো বলেন, ‘আমি চার থেকে পাঁচদিন তাদের (পাকিস্তানীদের) হুকুম পালন করেছি। একবার সবাইকে গুলি করে হত্যার পর তারা লাল একটি জিপ নিয়ে চলে যাবার আগে আমাকে মাটি চাপা দিতে বলে যায়। আমি যখন কুদাল দিয়ে মানুষগুলোর উপর মাটি দিচ্ছিলাম, তখন দেখেছি গুলিবিদ্ধ সুঠাম দেহের অনেকে গর্ত থেকে উঠার চেষ্টা করছেন। ভয়ে তখন আমি পালিয়েছিলাম।’
তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অপূর্ব শর্মা’র সাথে কথা হলে তিনি জানান, ‘বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও গণকবরটি সংরক্ষণ না করায় মুক্তিযুদ্ধের বড় একটি ইতিহাস বিস্মৃতির আড়ালে পড়ে রয়েছে। এটি সংরক্ষণ করা না গেলে একসময় হয়তো জায়গাটি বেদখল হয়ে যাবে।ইতিমধ্যে অনেক গণকবর দখল হয়ে গেছে।’
৫ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন ভবতোষ রায় বর্মণ রানা। প্রবীণ এই বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, এটি গণকবর এবং বধ্যভূমিও। সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষকে গাড়ি করে এনে এখানে হত্যা করা হতো। বেশকিছুদিন এখানে গণহত্যা চালানো হয়। স্বাধীনতার পরে বেশ কয়েকবার জায়গাটির উপর জরিপ চালানো হয়, নকঁশাও করা হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেন সংরক্ষণ করা হচ্ছে না, জানি না। সংরক্ষণ না করায় ইতিহাসের একটি অধ্যায় থেকে নতুন প্রজন্ম বঞ্চিত হচ্ছে। এটি সংরক্ষণ করা জরুরী।’
এ প্রসঙ্গে কথা হলে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঊর্মি রায় জানান, ‘জায়গাটি সংরক্ষণ করা দরকার ইতিহাসের স্বার্থে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বেশ কয়েকবার। বর্তমানে জায়গাটি সিটি কর্পোরেশনের অধীনে চলে যাওয়ায় আমরা কিছু করতে পারছি না।’
সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সাথে বিষয়টি নিয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।