যুদ্ধের সময় গর্তে লুকিয়ে থাকা দিনগুলো আজো ভুলেননি সুফিয়া আক্তার
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ৮:৩৭:১২ অপরাহ্ন

আহমাদ সেলিম :
সম্মুখ সারির যুদ্ধ নয়, তবুও করুণ, লোমহর্ষক এক একটি মুক্তিযুদ্ধের গল্প ছড়িয়ে রয়েছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশে। শহর এবং গ্রামের অনেক পরিবারে সেই গল্পগুলো জমা হয়ে আছে পরম যত্নে। যারা সেসময় অস্ত্র ছাড়াও যুদ্ধ করেছেন। তবে সেই যুদ্ধ ছিলো পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বাঁচার। এজন্য এক একটি পরিবারকে অবর্ণনীয় কষ্ট পোহাতে হয়েছে, পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয়েছে মাইলের পর মাইল পথ। ছুটতে হয়েছে একগ্রাম থেকে আরেক গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের তেমনি একটি গল্প জড়িয়ে আছে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার দক্ষিণ জয়পাশা গ্রামের সুফিয়া আক্তার মিনার জীবনের সঙ্গে।
সুফিয়া আক্তারের বয়স ষাটের ঘর পেরিয়ে গেছে। এখনো তার কাছে, সকালের রোদের মতো সতেজ একাত্তরের দিনগুলো। গ্রামের কাকে কাকে পাঞ্জাবীরা (পাক হানাদাররা) ধরে নিয়ে গিয়েছিলো, তাদের নামও মুখস্ত। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুফিয়া আক্তার সাত বছরের শিশু, পরিবারের বড় সন্তান। সে সময় মা-বাবা ছাড়াও দাদী আয়মনা বিবি, ছোট এক ভাই সিপার আহমেদ এবং দুই বোন রুবি এবং রোজি ছিলেন সংসারে। যুদ্ধদিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, ‘কার ঘরে কয়টি মুরগি আছে, সেই খবর তো পাঞ্জাবীদের জানার কথা নয়। আমাদের মানুষগুলোই আমাদের সর্বনাশ করেছে। আমার মনে আছে, একদিন রাতে পায়ে বড় বুট আর কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে হঠাৎ মিলিটারির লোকজন আমাদের বাড়িতে এলো। বিষয়টি বুঝতে পেরে বাবা আমার মাকে ঘরে রাখা ধানের ভাড়াড়ের পাশে লুকিয়ে রাখলেন। আমি তখন খাবারের জন্য কাঁদছি। পাঞ্জাবীরা জানতে চয়েছে, আমি কেন কাঁদছি, আমার মা কোথায়? দাদি আয়মনা বিবি বলছেন, জানিনা কোথায় গেছে। দাদীর কথা বিশ্বাস করেনি। এজন্যই হয়তো টয়লেট পর্যন্ত খুঁজেছে।’
মাথায় সাদা চুলের ভিড়ে কালো চুলগুলো উঁকি দিচ্ছে। চশমায় পড়েছে সময়ের ছাপ। চারপাশে বসে আছেন মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম। চায়ের ধোঁয়া উড়ছে এলোমেলো, সুফিয়া আক্তারের কথার দিকে সবার মনোযোগ।
‘অগ্রহায়ণ মাস ছিলো। সেবার অনেক ধান হয়েছিলো হাওরগুলোতে। গাছে গাছে শিম ঝুলছিলো, কিন্তু মানুষের মনে আনন্দ ছিলো না। প্রায় প্রতিদিন তখন গুলির আঘাত, বোমার শব্দ। আশপাশের কোথাও বোমা পড়লে বুক কেঁপে উঠতো। রাত হলে ভয় বেড়ে যেতো। অনেক হিন্দু পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। বাবা বাড়ির পূর্ব দিকে প্রায় চারহাত লম্বা কবরের মতো একটা গর্ত করলেন। রাত হলে বাবা আমাদের ওই গর্তে লুকিয়ে রাখতেন। গর্তে ঢুকার পর উপরের অংশটি কাঠ দিয়ে ঢেকে, তার উপর পাতা-লতা, ধানের খড় ছড়িয়ে দিতেন বাবা। এভাবে ভয়ঙ্কর সময় আমরা পার করে আজকের এই বাংলাদেশ দেখছি।’
‘একবার আমরা গর্তে লুকিয়ে। বাইরে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ শুনছি। গর্ত থেকে মুখ বের করে আকাশের দিকে তাকাতেই দমক খেয়েছিলাম। আজো ভুলিনি সেদিনের কথা। সেদিন আকাশে চিলের মতো বিমানের উড়াউড়ি দেখেছি।’
তিন ভাই পাঁচ বোনের মধ্যে সুফিয়া আক্তার সবার বড়। বাকি সব ভাই-বোনেরা এখন সংসারী। যুদ্ধের গল্প বলার সময় ছোট ভাই-বোন এবং তাদের সন্তানরাও সেই গল্প শুনছেন। কিন্তু সবার থেকে আলাদা দরদ যেন সুফিয়া আক্তারের চোখে মুখে। কারণ, যুদ্ধের বিভীষিকা একমাত্র তিনিই কাছ থেকে দেখেছেন, আর সেই দিনগুলো বায়ান্ন বছর ধরে আগলে রেখেছেন বুকের মানচিত্রে।
গল্প চলছে। সুফিয়া বেগম বলছেন, ‘আমার বাবা আমিন আলী মুক্তিযোদ্ধা নন। তবে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পছন্দ করতেন, লুকিয়ে সহায়তা করতেন। এ খবর পেয়েই হয়তো আমাদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার পাঞ্জাবীরা এসেছে। তবে এভাবে গর্তে লুকিয়ে থাকাটা যেন আর ভালো লাগছিলো না। আমরা একদিন পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেলে চলে গেলাম সাত থেকে আট মাইল দূরে, কিয়ারতলা নামক একটি গ্রামে। যার বাড়িতে উঠেছি, তিনি আমাদের আপন কেউ নন। বাবা ব্যবসায়ী থাকার সুবাদে উনার সাথে অনেক দিনের পরিচয়। এই পরিচয়ে ছয়দিনের মতো থাকতে হয়েছে উনার বাড়িতে। সেই বাড়ির লোকজনের আতিথেয়তা আজও ভুলতে পারিনি। উনার বাড়ি থেকে আবার পায়ে হেঁটে রওয়ানা হলাম আনুমানিক ছয় কিলোমিটার দূরে, নানার বাড়ি লংলার পুরসাই গ্রামে। বাড়ি থেকে বের হবার সময় বাবার প্রিয় পোষাপ্রাণী সেই কুকুর, সেই বিড়ালকেও সাথে নিয়ে আসতে ভুলিনি।’ তিনি বলেন, ‘পেছনে শুধু বাড়ি ফেলে আসিনি। আরো অনেক কথা ফেলে এসেছি। একবার গ্রামের সৈয়দ জামান, তৈয়ব আলী, ধলাই মিয়াসহ বেশ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায় পাঞ্জাবীরা। অপরাধ একটাই, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন গোপনে।
যুদ্ধ শেষে আমরা বাড়ি ফিরছি। আসার সময় দেখছি, সবকিছু তছনছ। নাকে ভেসে আসছে লাশের গদ্ধ। বোমার আঘাতে অনেককিছু উড়ে গেছে। অচেনা মনে হচ্ছে কুলাউড়া রেল স্টেশনকে। লুটপাট হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, বাসা-বাড়িতে। বাড়িতে এসে দেখলাম, অনেক কিছু নেই, অনেক কিছু আছে। প্রতিবেশী অনেকেই সেই যে পালিয়েছেন, আর ফিরে আসেননি। তারপর থেকে আজকের এই আমি। কিন্তু আজো ভুলতে পারিনি সেই দিনগুলোর কথা, সেই গর্তের ভেতর লুকিয়ে থাকা বোমারু বিমানের কথা।’
যুদ্ধসময়ের এরকম বিবর্ণ বহু গল্প ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে। ইতিহাসের স্বার্থে সেই দিনগুলো নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা দরকার-এমনটা মনে করেন সুফিয়া আক্তার মিনা।