ডাক্তারবাড়ি ও কয়েকটি বিপর্যয়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ২:০৫:২১ অপরাহ্ন
রফিকুর রহমান লজু :
রায়নগর সোনারপাড়ার ‘রাসোস’ আবাসিক এলাকার একটি পরিচিত বাড়ি ‘ডাক্তারবাড়ি’। সাদামাটা বাড়ি হলেও একাধিক কারণে বাড়িটি পরিচিতি পেয়েছে। এই বাড়ির সঙ্গে একটি ছোট্ট ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এই বাড়িতে এক সময় হাফিজ আবদুল করীম যিনি কৌড়িয়ার শেখ সাহেব নামে অধিক পরিচিত ছিলেন, সম্মানিত অতিথি হিসেবে তিনি এই বাড়িতে দীর্ঘদিন অবস্থান করেছেন। তিনি পাড়ার মসজিদ রায়নগর সোনারপাড়া জামে মসজিদে খতমে তারাবি পড়িয়েছেন। সে সময় চাইলেই এখনকার মতো কুরআনে হাফিজ পাওয়া যেতো না। তাই বিশ রাকাত নামাজ একজনকেই পড়াতে হতো। তখন সকল মসজিদের জন্য হাফিজও পাওয়া দুস্কর ছিলো।
হাফিজ আবদুল করীম ডা. আবদুল মন্নানের জামাতা বিশিষ্ট চা-কর ও পাট ব্যবসায়ী সোলেমান খানের মেহমান হিসেবে তাঁর ঘরে থাকতেন। তখন সোলেমান খান এই বাড়িতে একটা ঘরে অবস্থান করতেন। পরে সোলেমান খান সুবিদবাজারে নিজস্ব বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে চলে যান। তাঁর আদি বাড়ি শহরের হাওয়া পাড়ায়।
ডা. আবদুল মন্নান মনাফ ডাক্তার হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন নিজ পাড়ায়। ক্রয় সূত্রে তিনি সোনারপাড়ার বাড়ির মালিক হয়েছেন। কিন্তু কার নিকট থেকে কিভাবে ক্রয় করেছেন, সে তথ্য পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয় কোনো সাবেক জমিদারের নিকট থেকে বাড়িটি ক্রয় করা হয়েছে। দর্জি পাড়ার বিশাল প্লট ফেলে রেখে সোনার পাড়ায় তাঁর ওঠে আসা ঠিক হয়নি বলে অনেকে মনে করেন।
মনাফ ডাক্তার সাহেব চার পুত্র সন্তানের জনক। তাঁরা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তারা চারজন হলেন মুহিবুর রহমান বাবু মিয়া, হবিবুর রহমান নন্দী মিয়া, শফিকুর রহমান তমু মিয়া ও সবার ছোট আতাউর রহমান আতা। তাঁরা কেউ আর বেঁচে নেই। আতা সকলের শেষে গত ৩ সেপ্টেম্বর (২০২১) শুক্রবারে ইন্তেকাল করেছেন।
ডাক্তার বাড়ির ডাক্তার আবদুল মনাফ মেডিকেল কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়ে ডাক্তার হন নাই। তিনি কবিরাজ ছিলেন। কিন্তু পড়ালেখা করে ডিগ্রি নিয়ে কবিরাজ হন নাই। ভারতের আসামের এক অবাঙালি কবিরাজের সঙ্গে কাজ করেছেন। এভাবে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এই সময় আসামের প্রত্যন্ত বাঙালি অঞ্চলে হঠাৎ করে কালাজ্বরের প্রকোপ হয়। ওই কবিরাজ কালাজ্বরের প্রতিষেধক হিসেবে আয়ুর্বেদ মতে একটি সালসা তৈরি করেন। কবিরাজ মহাশয়ের সালসাটি খুবই ফলদায়ক হয়। তাঁর গবেষণা সফল হয়। অত:পর ডা. মনাফ নিজে সালসাটি তৈরি করেন একই ফর্মুলায়। পরে এক সময় সিলেটের জৈন্তাপুর অঞ্চলে কালাজ্বর রোগটি ব্যাপক আকারে দেখা দেয়। অনেকে ভয়ে অন্যত্র চলে যায়। ডা. মনাফ সালসা বোতলে ভরে বাজারজাত করেন। প্রতিদিন প্রচুর বিক্রি হতো, অঢেল মুনাফা আসতো। তখন থেকে তাঁর আর্থিক সচ্ছলতা আসতে শুরু করে। এই হলো ডাক্তার বাড়ির মনাফ ডাক্তারের ইতিহাস। ডাক্তার বাড়ির গোড়াপত্তনকারীর নাম লেখাপড়ায় আব্দুল মন্নান হলেও তিনি এলাকায় পরিচিত মনাফ ডাক্তার হিসেবে। বাড়িটির নামও হয়েছে তাই মনাফ ডাক্তারের বাড়ি। মনাফ ডাক্তার এই বাড়িটির মালিক হয়েছেন সম্ভবত ক্রয়সূত্রে। তিনি এখানে ওঠে আসার আগে জায়গাটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। শিয়াল-টলা-বানরের আস্তানা ছিলো। তিনি জায়গাটি সংস্কার করে মানুষ করেছেন, মনুষ্যবাসের উপযোগী করে তুলেছেন। বাড়ির সঙ্গে তাঁর নাম যুক্ত থাকায় তিনিও স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
ডা. মনাফের বাড়িতে হাফিজ আবদুল করীম সাহেবের থাকার ব্যাপার ছাড়াও অন্যান্য কারণেও বাড়িটি পরিচিতি পেয়েছে। এখানে এক নাগাড়ে পরপর কয়েকটি বিপর্যয় ঘটেছে। করুণ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
মনাফ ডাক্তারের বড় ছেলে মুহিবুর রহমান বাবু মিয়ার বড় ছেলে মখলিসুর রহমানকে একদিন ঘরের মধ্যে মৃত পাওয়া যায়। রাতে কখন কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছে কেউ বলতে পারে না। তার স্ত্রীও কিছু টের পায়নি।
ডাক্তার সাহেবের ২য় পুত্র হবিবুর রহমান নন্দী মিয়ার ছেলের ঘরের নাতি জিয়াউর রহমান তামিম অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। তামিমের মৃত্যুর পূর্বে তার পিতা মন্তাজুর রহমান মরণব্যাধি ক্যান্সারে মারা যান।
তামিমের অর্শ্বরোগ (পাইল্স) হয়েছিল। লজ্জায় বাড়িতে কাউকে সে বলেনি। কোনো বন্ধু বা বাড়িতে চাচাতো ভাইদেরও সে জানায়নি। এক কবিরাজের কাছে গিয়ে সে গোপনে চিকিৎসা করিয়েছে। কবিরাজ যে চিকিৎসা দিয়েছে সেটা হত্যা করারই নামান্তর। কবিরাজ গুহ্যদ্বারে এসিড মেরে তামিমের নাড়িভুড়ি কিডনি জ্বালিয়ে দিয়েছে। জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সে শেষ মুহূর্তে বিষয়টি প্রকাশ করেছে। তখন বিলম্ব হয়ে গেছে। তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। তার জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। তামিম যখন বুঝেছে তার সময় আর বেশি নেই, তখন সে মা-চাচী ও অন্য সকলের নিকট মাফ চেয়েছে, কেঁদেছে।
তামিম গত রমজান (১৪৪২) মাস শেষে ছয় রোজা রেখেছে। একই সাথে তার আব্বার জন্য দু’টি নফল রোজা রেখেছে।
ডা. মনাফের ৩য় ছেলে শফিকুর রহমান তমু মিয়ার ঘরেও বিপর্যয় ঘটেছে। তমু মিয়ার পিঠাপিঠি দুই পুত্র আজল ও আজিম কিছুটা মানসিক বিকারগ্রস্থ ছিলো। আজিম আবার মৃগী রোগী ছিলো। একদিন সে নীরবে অন্য জগতে চলে যায়।
আবহাওয়া ও পরিবেশ পরিবর্তনের জন্য আফজলকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়। সে উমরা হজ্ব করেছিলো। দেশে ফিরার পর দেখা যায় সে সুস্থ হয় নাই। পরে তার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছিলো। একই সঙ্গে করোনায়ও আক্রান্ত হয়েছিলো। আমাদের মহল্লায় করোনার প্রথম শিকার আফজল।
তমু মিয়ার বড় ছেলে লুৎফুর রহমান আশরাফের স্ত্রীর ব্রেইন টিউমার হয়েছিলো। অপারেশন করে টিউমার সারাতে গিয়ে তার অকাল মৃত্যু হয়েছে। আশরাফ আর বিয়ে করেনি। ১ম স্ত্রীর ঘরে তার দুই ছেলে রয়েছে।
মনাফ ডাক্তারের সব ছোট ছেলে (চার নং) আতাউর রহমান আতা ভাইদের মধ্যে সব শেষে বিদায় নিয়েছেন। তিনি সকল বিপর্যয় দেখেছেন, মুখ বুঝে সব সহ্য করেছেন। তাঁর নিজ সংসারেও বিপর্যয় আছে, করুণ মৃত্যু আছে। বিপর্যয়ের শুরু তাঁর সংসার থেকেই। তাঁর বড় ছেলে হাসিনুর রহমান হাসিন এক বিদঘুটে বিমারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বিদেশে পাঠিয়েও তার চিকিৎসা করানো হয়। তার হার্ট এ্যাটাক করেছিলো। সে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলো। নিচ দিক পা পর্যন্ত বেহবদ হয়ে গিয়েছিলো। এ অবস্থায়ই তার জীবন শেষ হয়।
আতাউর রহমানের ২য় ছেলে অলিউর রহমান শিপু বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে নির্মমভাবে অসহায়ভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। লালদীঘিরপারে দু’তলায় তাদের বোর্ডিং ছিলো। রাতে বোর্ডিং থেকে ফেরার সময় একখানা ইস্পল্টু নিয়ে নামছিলো। হঠাৎ বিদ্যুৎ লাইনের সঙ্গে লেগে ইস্পল্টুতে কারেন্ট চলে আসে আর সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হয়। তার হাত ও শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে যায়।
এভাবে মনাফ ডাক্তারের পরিবারে এক সময় পরপর কয়েকটি বিপর্যয় ঘটেছে। মৃত্যু সকলের জন্যই অনিবার্য। কেউ কারো মৃত্যু ঠেকাতে পারে না।
কুল্লু নাফসিন জা ইকাতুল মউত। সকলেরই মৃত্যু হবে। এটা অবধারিত। কিন্তু কার মৃত্যু কবে কখন হবে, কিভাবে হবে, তা আমরা বলতে পারি না, জানি না। জানা সম্ভবও নয়।
মহান আল্লাহ সবাইকে ক্ষমা করুন, জান্নাতবাসী হিসেবে কবুল করুন।
লেখক : সিনিয়র কলামিস্ট।