নির্বাচন ও একটি জাতির নবজন্ম
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ২:১৫:৪৭ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস :
দেশে নির্বাচনের হাওয়া বইছে। কখনো মনে হয় এ যেন এক খেলা। দেশীয় খেলোয়াড়, বিদেশী খেলোয়াড় সবাই এ খেলায় মত্ত। কিন্তু নির্বাচন তো কোন খেলা নয়। আর খেলাই যদি হয় তাহলে সেটা এমন খেলা নয় যে যখন ইচ্ছা তখন খেললাম, যখন ইচ্ছা খেললাম না। এ খেলায় দেশ জাতির মানসম্মান জড়িয়ে আছে। এ খেলা শুধুই খেলা নয়, এ খেলা খেলতে হয় মন-প্রাণ-হৃদয় দিয়ে। এ খেলা খেলতে হয় সামনে আদর্শ নিয়ে, উদ্দেশ্য নিয়ে, খেলতে হয় জাতির জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে।
যে খেলা খেলে ছিলেন আজকের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু উনিশ’শ সত্তর সালের শেখ মুজিবুর রহমান। খেলার মাঠ ছিলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। নির্বাচনী খেলার একটি দল ছিল আ’লীগ। দলনেতা ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার একসময়ের খোকা মুজিব। শেষ ঠিকানা ছিলো ঢাকার ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে হয়ে উঠে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আজকের বাঙালি জাতির জনক। এতো ইতিহাস। বার বার বর্ণিত উচ্চারিত কোন মিথ্যার ফানুস নয়। এমন ফানুস যারা উড়ায় তারা জানে না মিথ্যার আয়ূ বড়োই কম। বঙ্গবন্ধুর সত্তরের নির্বাচনী খেলার ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী যারা এখনো বেঁচে আছেন তারা তো অবশ্যই জানেন যে, বঙ্গবন্ধু একদিনে ফাইনাল খেলায় নামেননি দলবল নিয়ে।
দীর্ঘ চব্বিশটি বছর ধরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের খেলার মাঠে খেলতে খেলতে নিজ দল নিয়ে দলপতি হয়ে নির্বাচনী ফাইনাল খেলায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি চব্বিশটি বছর ধরে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়িয়েছেন। কতো জেল জুলুম। কতো নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। তারপর তাঁর এবং তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। পাকিস্তানী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সামরিক জান্তা আয়ূব খান এহেন নির্যাতন নেই যে তিনি তা করেননি; তারপরও বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা থেকে সরে আসেননি। ছয় দফা সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মাঝে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। সে সময় আ’লীগের অনেক বিশিষ্ট নেতা ছয় দফাকে ভয়ে এবং বিভিন্ন কারণে আন্তরিকভাবে সমর্থন করেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক ডাকে আর আহ্বানে বাংলার জনগণ ছয় দফাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য কেউ কেউ অর্থাৎ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা স্লোগান দিয়েছিলেন- ‘ভোটের বাক্সে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। কিন্তু না, বাংলার মানুষ লাথালাথিতে কর্ণপাত করেননি। ১৯৭০ এর নির্বাচনে সর্বশক্তি দিয়ে সেদিন ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হলেন। সেদিন পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা বোধ হয় মনে করেছিলো যে আ’লীগ এককভাবে জয়ী হবে না। তারা অঙ্কে ভুল করে ইয়াহিয়ার কাছে গোয়েন্দা রিপোর্ট করেছিলো।
সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার গোয়েন্দা রিপোর্টের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে অবাধ নির্বাচন দিতে রাজী হয়েছিলেন। নইলে ইয়াহিয়া এমন কোন গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন না যে তিনি এ নির্বাচন দিবেন। তার কূটনৈতিক চালে ভুল করেছিলো বলেই তিনি নির্বাচন ভন্ডুল করেননি। ফলে বঙ্গবন্ধুর দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হলেন। সরকার গঠনের অধিকার পেলেন।
দুই.
তারপরের ঘটনা কারো অজানা থাকার কথা নয়। সেদিন ভুট্টো-ইয়াহিয়া চক্র ভয় পেয়েছিলো। বাঙালিদের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারলো না। নানা টালবাহানার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু এবং তার দলের হাতে ক্ষমতা দিতে চাইলো না। ইয়াহিয়া অনেকটা উপহাস করেই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী বলে সম্বোধন করেছিলেন। আসলে সেটা ছিলো তার ষড়যন্ত্রেরই নামান্তর।
বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার আড়ালে ভুট্টো-ইয়াহিয়া চক্র শুধু কালক্ষেপন করছিলো। এবং গোপনে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও সেনা আনার ব্যবস্থা করেছিলো। এদের ষড়যন্ত্র বুঝেই বঙ্গবন্ধু নতুনভাবে ভাবতে লাগলেন। বাংলার মানুষের ধৈর্য্যরে বাঁধ ভাঙ্গতে লাগলো। এলো ৭ই মার্চ ১৯৭১ সাল। রেসকোর্স ময়দানে দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে হাজির হলেন লাখো লাখো জনতার মাঝে। জানালেন বাস্তব পরিস্থিতি। কালোজয়ী ভাষণ শুরু করলেন। ডাক দিলেন ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে। পরোক্ষভাবে তিনি বাংলার স্বাধীনতার ডাক দিলেন। বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তি সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি আরো বলেন- ‘রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ ভাষণটির আদ্যপ্রান্ত একটু মনোযোগ দিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও পরোক্ষভাবে ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালের ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ভাষণেই বঙ্গবন্ধু আসলে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। আর সে ঘোষণার পর পরই শুরু হয়ে যায় বাঙালির মুক্তি আর স্বাধীনতার সংগ্রাম। অর্থাৎ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। শত চেষ্টা আর ফন্দি-ফিকিরের মাধ্যমেও বিশ্বের তাবৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর নেতৃবৃন্দের শত বিরোধীতার পরও বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে প্রতিহত করতে পারে নাই। বাংলার ইতিহাস, বিশ্ব ইতিহাস এর সাক্ষী।
এখন প্রশ্ন হলো- এই ৭ই মার্চের ভাষণ দেবার শক্তি-সাহস বঙ্গবন্ধু কোথায় পেয়েছিলেন? এই প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া আজ একান্ত জরুরি। এ প্রশ্নের উত্তরে কে কি বলবেন জানি না। তবে আমার মতো এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষের ধারণা বা বিশ্বাসটি হলো- বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সাহসের উৎস ছিলো- ১৯৭০ সালের নির্বাচন। আর সে নির্বাচনের বিজয়ের ফলাফলই বঙ্গবন্ধুকে সাহসী করে তুলেছিলো। ঐ নির্বাচনের বিজয় মানেই সেদিন ছিলো বঙ্গবন্ধু আর তাঁর দল আ’লীগের প্রতি সাড়ে সাত কোটি মানুষের অকুন্ঠ সমর্থন। সেই নির্বাচন শুধুই একটা নির্বাচনই ছিলো না। সেই নির্বাচন মানেই একটি অসহায় জাতির, একটি পরাধীন জাতির মুক্তি সাধন। এটা পৃথিবীর নির্বাচনী ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। শুধু তাই নয়- এমন ইতিহাস কোন জাতির ইতিহাসে নেই। একটা নির্বাচন কিভাবে একটি জাতির জন্ম দিতে পারে, জন্ম দিতে পারে একটি স্বাধীন দেশের তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
আজ ২০২৩ এ দেশে নির্বাচনী হাওয়া বইছে। উৎসবে মেতে উঠছে সারা জাতি। ঘটে যাচ্ছে অনেক ঘটন-অঘটন। কেউ নির্বাচনী ট্রেনে উঠবেন, কেউ কেউ উঠবেন না। সবাই নিজেকের আমরা সঠিক বলে মনে করছি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী নয়। তবুও সংশ্লিষ্ট সবার কাছে আবেদন নিবেদন- আসুন আমরা একবার ফিরে তাকাই পেছনে ১৯৭০ এর নির্বাচনের দিকে। নির্বাচন কাকে বলে জানতে একটু চেষ্টা করি।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা।