সিলেট-সুনামগঞ্জের চার বর্ডার হাট
ব্যবসায় আধিপত্য ভারতীয়দের, বাংলাদেশীদের মাঝে হতাশা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫:১০ অপরাহ্ন
নূর আহমদ :
বাংলাদেশের হাঁস-মোরগ, মাছ-মাংস, ডিম ও শুটকি নিতে ভারতীয়দের আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু অনুমোদন না থাকায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের বর্ডার হাটগুলোতে তা বিক্রি করতে পারছেন না বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা চরম হতাশ। বিপরীতে ব্যাপক সাফল্য পাচ্ছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। তারা প্রতিটি হাটে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের চেয়ে গড়ে তিনগুণ বেশি পণ্য বিক্রি করছেন। ভারতীয় শেডে ক্রেতাদের ভীড় দেখা গেলেও উল্টো চিত্র থাকে বাংলাদেশী শেডে। বাংলাদেশী ক্রেতা প্রবেশে ঢিলেঢালা মনোভাব থাকলেও ভারতীয় ক্রেতাদের হাটে আসতে ব্যাপক কড়াকড়ি করা হয়। অন্যদিকে হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ মেয়াদোত্তীর্ণ মালামাল উত্তোলনের অভিযোগ করা হয়েছে।
সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জের সদর, তাহিরপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলা সীমান্তে ৩টি বর্ডার হাট চালু রয়েছে। আর অপরটি সিলেটের ভোলাগঞ্জ সীমান্তে রয়েছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও জুড়িতে আরো দুটি হাট চালুর প্রস্তাবনা রয়েছে। এরমধ্যে কমলগঞ্জের কুমারঘাটে হাটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে সিলেট ও সুনামগঞ্জে হাট চালু রয়েছে চারটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ২য় বর্ডার হাট সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার ডলুরা বর্ডার হাটে সিলেট অঞ্চলের অন্য হাটের তুলনায় একটু ভালো ব্যবসা হয় বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের। নতুন চালু হওয়া সিলেট ও সুনামগঞ্জের বাকী তিনটি হাটে ব্যবসা নিয়ে হতাশ বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা।
বর্ডারহাটগুলোতে দুই দেশের ৫২টি পণ্য বিক্রির অনুমতি রয়েছে। সে অনুযায়ী চলে পণ্য বিক্রি। বাংলাদেশীদের কাছে ভারতীয় খাসিয়া পান, সুপারি, কসমেটিকস, জুতা, জিরা, আদা, কিশমিশ, শীতের কম্বল, চাদরসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য বেশ জনপ্রিয়। অন্যদিকে ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশের জনপ্রিয় পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে সবজি, মেলামাইন-প্লাস্টিকের সব ধরনের সামগ্রী, কাপড়, গৃহস্থালি তৈজসপত্র, লিচু ড্রিং ও চানাচুর ইত্যাদি। দুই দেশের সীমান্ত থেকে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত যারা বাস করে তাদেরই মূলত সীমান্ত হাটে ব্যবসা বাণিজ্য করার অনুমতি কার্ড দেয়া হয়েছে। এ কার্ড ব্যবহার করে একজন ২০০ ডলার (বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৭ হাজার টাকা) মূল্যের পণ্য কিনতে পারেন প্রতি বাজারে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সীমান্ত এলাকায় বৈধ বাণিজ্য নিশ্চিতের লক্ষ্যে এসব সীমান্তহাট স্থাপন করা হয়েছে। সীমান্তে বাসকারীদের কর্মসংস্থান ও চোরাকারবারিদের ঠেকাতে দুই দেশের সরকার এ হাট চালু করে। প্রতিহাটে দুই দেশ মিলে ৫০ জন ব্যবসায়ী ব্যবসার সুযোগ পাচ্ছেন।
ডলুরা বর্ডার হাটের অবস্থান সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নে। সপ্তাহে মঙ্গলবার এই হাটে দুই দেশের বৈধ কার্ডধারী ব্যবসায়ীরা বেচাকেনা করেন। ২০১০ সালের মে মাসে বর্ডার হাটের আনুষ্ঠানিক যাত্রায় বেচাকেনা শুরু হয়। মধ্যখানে করোনার কারণে কিছুদিন বন্ধ ছিল। এরপর পুনরায় চালু হয় হাট।
এই হাটের বাংলাদেশী ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম জানান, হাটের বাংলাদেশ অংশে বেলা ১১টায় হাট খুলে দেয়া হলেও, ভারত থেকে গেট খোলা হয় বেলা ১টায়। সে কারণে ভারতীয় ক্রেতারা কম আসে, বেচা-বিক্রিও কম হয়। এই ব্যবসায়ীর অভিযোগ বিএসএফ তাদের ক্রেতাদের হাটে আসার ব্যাপারে বেশ কড়াকড়ি করে। তিনি জানান, এই হাটে বাংলাদেশী পণ্যের মধ্যে প্লাস্টিক পণ্য সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। তিনি আরো জানান, প্রতি হাটের দিন বাংলাদেশীরা গড়ে ১০ লাখ টাকার মতো বিক্রি করেন। বিপরীতে ভারতীয় বিক্রেতারা এর প্রায় তিন গুণ বিক্রি করেন বলে দাবি করেন আব্দুর রহিম।
হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রসিদ আহমদ বলেন, বাংলাদেশীরা হুজুগে ক্রেতা। বিদেশী পণ্য দেখেই হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এর মধ্যে অভিযোগ উঠেছে ভারতীয়রা মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য নিয়ে আসছেন। তিনি জানান, বিষয়টি বর্ডার হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় একাধিকবার তুলা হয়েছে। তিনি দু’দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে কিভাবে ব্যবসা একতরফা না হয় সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন।
২০২২ সালের ১২ মে সুনামগঞ্জের বোগলা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী বাগানবাড়ি এলাকায় চালু হয় বাগানবাড়ি-রিংকু বর্ডার হাট। এই হাটে দুই দেশের সীমান্ত এলাকার লোকজন কৃষি, খাদ্য, হস্তশিল্পের পণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাবেচা হয়। সপ্তাহে একদিন বৃহস্পতিবার এই বর্ডার হাট বসে। এই হাটেও কেনাবেচা একতরফা।
হাটের ব্যবসায়ী আলমাছ আলী বলেন, হাটে দোকান নিয়ে বসলেও ভারতীয় ক্রেতারা কম আসে। তার কারণ ওই দেশের বিএসএফ তাদের ঢুকতে দেয় না। আর বাংলাদেশের সবাই ঢুকে ভারতীয় পণ্য কিনে। অথচ বাংলাদেশের পণ্য বেশি চলে না। তিনি বলেন, আমাদের উৎপাদিত সবজি নিয়ে আসলেও বিক্রি না করে ফিরে যেতে হয়।
বাগানবাড়ি রিংকু বর্ডার হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য ও বোগলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিলন খান বলেন, সপ্তাহে একদিন এই হাটে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকার বেচাকেনা হয়। ভারতীয় ক্রেতারা না টানলে দেশের ব্যবসায়ীরা লোকসান দিতেই থাকবেন। তিনি এ বিষয়ে জেলা প্রশাসককে অবহিত করেছেন বলে জানান।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সাহেদাবাদে অবস্থিত সাহেদাবাদ বর্ডার হাট প্রতি সপ্তাহে বুধবার একদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বসে। এখানে ভারতের ২৬টি ও বাংলাদেশের ২৪টি স্টল রয়েছে। হাটের বাংলাদেশী ব্যবসায়ী রইছ উদ্দিন বলেন, এই হাটে ভারতীয় ক্রেতারা কম আসেন। তবে তাদের আগ্রহ প্লাস্টিক পণ্যের প্রতি। এর জন্য আর এফ এল বা অন্য পণ্যের বিক্রি হয় বেশি।
রইছ উদ্দিন জানান, তিনি চিপস ও বুট বিক্রি করেন। কোন রকমে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন বলে জানান। বিপরীতে ভারতীয়দের বিক্রি দ্বিগুণ হবে বলে জানান।
সাহেদাবাদ বর্ডার হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য ও বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: নিজাম উদ্দিন জানান, বাংলাদেশ অংশের রাস্তাঘাট ভালো নেই। তবুও ক্রেতারা উপচে পড়েন। তিনি জানান ক্রেতা কার্ড সাড়ে ৫শ রয়েছে। ব্যবসা দিমুখী করতে হলে দু’দেশের সমন্বয় প্রয়োজন বলে তিনি জানান।
অন্যদিকে ভারতের মেঘালয়ের ইস্ট খাসি হিলস ও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে এই বর্ডার হাটের অবস্থান। এই হাট বসে প্রতি শনি ও বুধবার। হাটের সময় সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা। বাংলাদেশি ক্রেতা প্রবেশে ঢিলেঢালা মনোভাব থাকলেও ভারতীয় ক্রেতাদের হাটে আসতে ব্যাপক কড়াকড়ি করে বিএসএফ।
ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতীয় ক্রেতারা বাজারে না আসায় বাংলাদেশী বিক্রেতারা হাটে দোকান খুলেন না। ২৪টি দোকানের বেশিরভাগই বন্ধ থাকে। মাত্র ২ ঘন্টায় ভারতীয় বিক্রেতাদের প্রায় অর্ধ কোটি টাকার মালামাল বিক্রি হয়ে যায়। সাড়ে ১০টায় বাজার ওপেন হওয়ার কথা থাকলেও ভারতীয় বিক্রেতাদের আসতে দুপুর ১২টা হয়। তবে ২টার মধ্যেই তারা তাদের পণ্যের অধিকাংশ বিক্রি করে ফেলে। বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন এই একতরফা বাজারকে ভারতের কাছে জনপ্রিয়তা বাড়াতে হলে মাছ মাংস শুঁটকি ডিম বিক্রির অনুমতি দিতে হবে।
ভারতের মাঝাই এলাকার বাসিন্দা অরুণ হাজং নামের এক দোকানি বলেন, তিনি ও তাঁর মা মায়া হাজং মিলে হাটে বিস্কুট ও কসমেটিকস বিক্রি করেন। এক দিনে তাদের ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়। প্রতি সপ্তাহে তারা আসেন। ব্যবসা নিয়ে তারা খুবই সন্তুষ্ট বলে জানান।
বর্ডার হাট ব্যবসায়ী ফরিদ মিয়া বলেন, বাংলাদেশের হাঁস-মোরগ, মাছ-মাংস, ডিম ও শুটকি নিতে ভারতীয়দের আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু অনুমোদন না থাকায় বিক্রি করতে পারছেন না।
ভোলাগঞ্জ বর্ডার হাট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জামান নোমান জানান, বাংলাদেশী বিক্রেতারা দোকান খোলে খরচের টাকা বিক্রি করতে পারে না। ভারতীয় ক্রেতারা তাদের চাহিদামতো মালামাল না পাওয়ায় বাজারে আসেন না। আমরা বাজার সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানিয়েছি। প্রতিকার পাচ্ছি না।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী জানান, তিনি নতুন এসেছেন। বর্ডার হাটের নানা সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে অবহিত হবেন। এরপর ব্যবস্থা নিবেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, বর্ডার হাট মূলত দুদেশের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক নিয়মে পরিচালিত হয়। সেখানে কি বিক্রি করা যাবে আর কোনটি করা যাবে না সব উল্লেখ রয়েছে। তিনি জানান, তবুও আমরা পর্যালোচনা করছি বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা কিভাবে সুন্দরভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন, ক্রেতা টানতে পারেন।
এ ব্যাপারে ভারতীয় হাই কমিশন সিলেট-এর সহকারী হাই কমিশনার নিরাজ কুমার জয়সওয়াল এর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।