বিশ্বনাথে নারীর রাজনৈতিক সচেতনতায় তিন অপরাজিতা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ জানুয়ারি ২০২৪, ১:৩৪:২৫ অপরাহ্ন
আনাস হাবিব কলিন্স :
বিশ্বনাথের নারীদের রাজনৈতিক অধিকার সচেতনতায় কাজ করে সফল তিন অপরাজিতা। সমাজে ও রাষ্ট্রে নারীর অগ্রগতি ও বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য তারা বিভিন্ন পর্যায়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন। এর মাধ্যমে দলবদ্ধভাবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
অপরাজিতা নেটওয়ার্কের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার এই তিন নারী সকল প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে নারী অধিকারের সংগ্রামে কাজ করে যাচ্ছেন। এই তিন নারী হলেন- বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বেগম স্বপ্না শাহীন, অলংকারী ইউনিয়ন পরিষদের তিনবারের সংরক্ষিত ওয়ার্ড সদস্য আমিনা বেগম আনু এবং বিশ্বনাথ উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসন থেকে এবারের নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ জয়িতা বিলকিস আক্তার।
নারী অধিকার ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সাথে সম্পৃক্ত এই তিন নারী জানান, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও নারীর অধিকার অনেকক্ষেত্রে উপেক্ষিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনো অনেক পুরুষ নারীর উত্তরণকে সহজে মেনে নিতে পারছে না। তবে এর উল্টো চিত্রের কথাও বলেন তারা । এই তিন সংগ্রামী নারী জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট জেলার একটি আসনেও কোন নারী প্রার্থী ছিলেন না।
তারা বলেন, বিশ^ এগিয়ে গেলেও জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের জায়গায় নারীর জোরালো অংশগ্রহণ কম। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, সকল রাজনৈতিক দলে ৩৩% নারীর অংশগ্রহণের বিধান রয়েছে। এটা নিশ্চিত হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর অবস্থান আরও সংহত হতো। অপরাজিতা নেটওয়ার্ক এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের উদার মনোভাব প্রত্যাশা করে।
বেগম স্বপ্না শাহীন : সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বেগম স্বপ্না শাহীনের সাথে তার পুরানগাঁওয়ের বাড়িতে কথা হয়। উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান থাকাকালে উপজেলা পরিষদের সকল কর্মকান্ডে সক্রিয় অবদান রাখতে পারেননি-এ প্রসঙ্গের অবতারণা করে তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিপুল কাজের সুযোগের বিষয়ে তিনি অবহিত ছিলেন না।
তিনি আরও জানান, ‘অপরাজিতা’ প্রকল্পের কারণেই তিনি এ বিষয়ে জানতে পেরেছেন এবং একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে বিভিন্ন কমিটি ও নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে পেরেছেন। অপরাজিতা নেটওয়ার্কের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ তার চোখ খুলে দেয়। অপরাজিতা থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে বর্তমানে একজন দক্ষ অপরাজিতা (নারী নেত্রী) হিসেবে নারীর ক্ষমতায়নে এবং নারীদের অধিকার আদায়ে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিজেকে যুক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, তার পাশাপাশি সাধারণ নারীদের রাজনৈতিক উন্নয়নমূলক কমিটি, ই্উনিয়নের স্ট্যান্ডিং কমিটি ও অপরাজিতা নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে সুযোগ করে দিয়েছেন। বেগম স্বপ্না বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন আমাদের কেউ সুযোগ করে দেবে না ,তবে আমাদের নেতৃত্বের মাধ্যমে দাবি করে আদায় করতে হবে। এজন্য নারীদেরই এক হয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, এই বিষয়টি একদিনের বিষয় নয়; দীর্ঘদিন তাদের দাবির মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক মূল দলে ৩৩% নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবো।’
আমিনা বেগম : বিশ্বনাথের টেংরা গ্রামের বাসিন্দা আমিনা বেগম অলংকারী ইউনিয়ন পরিষদের তিন তিনবারের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য। তার পেছনের গল্প জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে না জানায় পুরুষ সদস্যদের হুকুম পালনেই তার প্রথম দশ বছর কেটেছে। সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য হিসেবে ২০১৯ সালে তিনি “অপরাজিতা” প্রকল্পের সাথে যুক্ত হন। এ প্রকল্পের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সভা-সেমিনারের সাথে তিনি যুক্ত হন। একজন নির্বাচিত নারী প্রতিনিধির দায়িত্ব-ইউনিয়ন পরিষদের অন্য প্রতিনিধিদের জানানোর পর অনেকের সাথে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সব বাধা এবং প্রতিবন্ধকতাকে এড়িয়ে তিনি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
তিনি আরো বলেন, অপরাজিতা নেটওয়ার্কে সম্পৃক্ততা- এক্ষেত্রে তাকে অনেক শক্তি, সাহস ও প্রেরণা দিয়েছে। বর্তমানে ইউপি সদস্য হিসেবে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য নিরসনে কাজ করে চলেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন বিচার সালিশেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।
আমিনা বেগম বলেন, পর পর তিন বার ইউনিয়ন পরিষদেই তিনি দেখেছেন পুরুষ সহকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা। এখন অধিকাংশ ইউপি সদস্য তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও দু’একজন সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না। তবে, দৃঢ় মনোবল নিয়ে বলেন, অপরাজিতা নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে সব বাধা ডিঙিয়ে নারীরা ক্ষমতায়িত হবে ও নারীদের অধিকার পাবে।
তিনি দুঃখ করে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট জেলায় একজনও নারী প্রার্থী ছিলেন না। অপরাজিতা নেটওয়ার্ক এর সদস্যরা আগামী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সাধারণ আসনে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করবে। আমিনা বেগম মনে করেন, তিনি একজন সফল অপরাজিতা।
বিলকিস আক্তার : বিশ্বনাথের হোসেনপুর গ্রামের সংগ্রামী নারী বিলকিস আক্তার। অপরাজিতা নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত এই নারী জানান, তার স্বামী সাব্বির আহমদ আনহার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেও সামাজিক কুসংস্কার নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কিন্তু নিজের দক্ষতা ও কাজ দিয়ে তিনি সকল বাধা ডিঙিয়ে উপজেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা হয়েছেন। গত ৯ ডিসেম্বর বিশ্বনাথ মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে তার হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেয়া হয় শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার। এ প্রসঙ্গে বিলকিস বলেন, শ্রেষ্ঠ জয়িতা প্রাপ্তি সম্ভব হয়েছে ‘অপরাজিতা’ প্রকল্পের সাথে যুক্ত থাকার কারণেই। এতে করে ‘অপরাজিতা’ প্রকল্পের প্রতি তার দায়বদ্ধতা আরো বেড়েছে বলে তার মন্তব্য।
তিনি আরও বলেন, নারীরা এখনও ঘরে বাইরে নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের “অপরাজিতা নেটওয়াকর্” আওয়াজ তুলেছে নারীদের আর বৈষম্যের শিকার হতে দেব না। এই বিশ^নাথ উপজেলায় এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুইজন নারী সাধারণ আসনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পুরুষের পাশাপাশি নারী অধিকার দাবিকে আরো সুদৃঢ় করতে আগামীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সাধারণ আসনে অপরাজিতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নারীর অংশগ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি করবে। ‘অপরাজিতা’ প্রকল্পের মাধ্যমে আরও শিখেছি জনপ্রতিনিধি না হলেও এলাকার লোকজনের বিভিন্ন নাগরিক সেবা দেওয়া সম্ভব। এর মধ্যে রয়েছে- জন্মনিবন্ধন তৈরি, সংশোধন, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার কার্ড, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ।
বিলকিস আরো জানান, ধর্মীয় পরিবারের বধূ হিসাবে একটি চক্র তাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। একজন অপরাজিতা হিসেবে তিনি সেই প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেছেন। বিশ্বনাথের খাজাঞ্চী ইউনিয়নে গড়ে তুলেছেন অপরাজিতা নারী উন্নয়ন সমিতি। সম্প্রতি সেটি উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন লাভ করেছে।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি সিলেট জেলা শাখার নির্বাহী সদস্য এডভোকেট জাকিয়া জালাল বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে তিন নারীর অগ্রযাত্রা-এটি মাইলফলক। নারীর অধিকার নিশ্চিতে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।