সংযোগ সড়ক, রাস্তা-ঘাট, কুয়াশা ও অটোরিক্সার অবাধ চলাচল মূল কারণ
সিলেট সড়ক দুর্ঘটনা এখনো উর্ধ্বমুখী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ৪:৩৪:৪০ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম/ সুনীল সিংহ :
সিলেটে সড়ক দুর্ঘটনার হার এখনো উর্ধ্বমুখী। গত তিন বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সড়কে হতাহতের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। আঞ্চলিক মহাসড়কের সাথে সংযোগ সড়ক, রোড মার্কিং না থাকা, ভাঙ্গাচোরা রাস্তা-ঘাট, কুয়াশা এবং সড়কে অটোরিক্সার অবাধ চলাচল -দুর্ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ বলে জানিয়েছেন সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।
হাইওয়ে পুলিশ সিলেট রিজিওনের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে (জুন-ডিসেম্বর) সিলেট অঞ্চলে মহাসড়কে ১১৬টি দুর্ঘটনায় ১২৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এছাড়া, ২০২২ সালে ১১২টি দুর্ঘটনায় ১২৩ জন এবং ২০২১ সালে ৮৫টি দুর্ঘটনায় ১০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ গত তিন বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়তির দিকে।
এদিকে, গত এক বছরে দৈনিক সিলেটের ডাক-এ প্রকাশিত রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, হাইওয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কে গত এক বছরে ১৭৬টি দুর্ঘটনায় ২৩৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এ সব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৩০৪ জন। নিহতদের মধ্যে ৩১ জন নারী ও ১৪ জন শিশুও রয়েছে। এর বাইরে জনপ্রতিনিধি, ডাক্তার, ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীও রয়েছেন। গেল বছর ৪০টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় ৪৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন ১৯ জন।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন
সড়কে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে অটোরিক্সাকে দায়ী করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো: সাইফুন নেওয়াজ। এর বাইরে মহাসড়কের সাথে সংযোগ সড়ক এবং রোড মার্কিং না থাকা দুর্ঘটনা বৃদ্ধির মূল কারণ।
সিলেট সড়ক জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. ফজলে রব্বে জানান, দেশের সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ১৮ ফুটের আঞ্চলিক মহাসড়কগুলো সবচাইতে বেশী বিপজ্জনক। এর চেয়েও বিপজ্জনক হলোÑ আঞ্চলিক মহাসড়কের সাথে কানেক্টিং সড়ক। উন্নত কোন দেশেই মহাসড়কের সাথে কানেক্টিং সড়ক থাকে না বলে তার মন্তব্য।
যানবাহনের সঠিক তদারকি (মেইনটেনেন্স) না থাকা, সঠিক জায়গায় ও বাঁকে মার্কিং না থাকা, সড়কের পাশের গাছপালা পরিচ্ছন্ন না করা, অতিবৃষ্টি ও কুয়াশা, সড়ক বাতি না থাকা, রাস্তার পাশে বড় বড় বিলবোর্ড, ওভারলোডিং, চালকদের দক্ষতার অভাব ও প্রশিক্ষণ না থাকা, চালকদের মোবাইল ব্যবহার, নারী যাত্রীদের অশালীন পোশাক পরিধান এবং রাস্তায় অনাকাঙ্খিতভাবে গরু-ছাগল-কুকুর-শিয়াল ঢুকে পড়াকে দায়ী করেন এ কর্মকর্তা। তিনি সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে দ্বিমুখী রাস্তার ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ঢাকা-”ট্টগ্রাম এবং ঢাকা-আরিচা সড়ক দ্বিমুখী হওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটা কমেছে বলে মন্তব্য করেন ফজলে রব্বে। মহাসড়কের মানদন্ড বজায় মেনে স্মার্ট সড়ক নির্মিত হলেই সড়কে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব বলে জানান তিনি।
হাইওয়ে পুলিশ সিলেট রিজিওনের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ মনে করেন, দুর্ঘটনা বাড়ার পেছনে যানবাহন বৃদ্ধির পাশাপাশি ভাঙ্গাচোরা রাস্তা-ঘাট ও কুয়াশাও অন্যতম কারণ। গত এক বছরে দ্রুত ও বেপরোয়া গতির কারণে ৪৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। যানবাহন হিসেবে সবচেয়ে বেশী দুর্ঘটনা ঘটেছে (৪৬টি) ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের। দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সবচেয়ে বেশী দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ছয় লেনবিশিষ্ট সিলেট-ঢাকা মহাসড়কেও দুটি সার্ভিস লেন থাকবে। নতুন এ মহাসড়ক নির্মিত হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে বলে জানান তিনি।
ভুক্তভোগীরা যা বলেন,
২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে নগরীর নয়াসড়ক পয়েন্টে ট্রাক-মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় এক পা হারান ব্যবসায়ী বিজয়রাজ মোদক নান্টু। দুর্ঘটনার পর তার ডান পা হাঁটুর উপর থেকে কেটে ফেলা হয়। সেই দুর্ঘটনার ক্ষত এখনো তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। পুরোপুরি সক্ষম না থাকায় তিনি ব্যবসায়িকভাবেও অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত। তার জীবনধারায় সকল ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আসে।
তিনি জানান, দুর্ঘটনার দিন রাতে বালুচরের ফ্যাক্টরী থেকে নগরীর মাছিমপুরের বাসায় ফিরছিলেন তিনি। ফিরতি পথে নয়াসড়কে পাথর বোঝাই একটি ট্রাক তার মোটর সাইকেলটিকে ধাক্কা দেয়। ফলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় ট্রাকটি তার ডান পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। এতে তার পায়ের হাড় চুরমার হয়। পরে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে রেফার্ড করেন। সেখানে তার হাঁটুর উপরাংশ কেটে ফেলা হয়।
দুর্ঘটনা রোধে বিশেষ করে নগরীতে ট্রাক চলাচলের সময়সীমা বেঁধে দেয়া ও তা কঠোরভাবে পালনের তাগিদ দেন এ ভুক্তভোগী। এ ধরণের অযাচিত দুর্ঘটনায় আর কেউ যেন না পড়ে-এটা তার কামনা।
চালক-মালিকরা যা বলেন:
সোহাগ পরিবহনের সাবেক চালক ও সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়নুল ইসলাম জানান, সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে এখনো আলাদা লেন তৈরি হয়নি। ফলে একই রোডে বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল করে। সরু সড়কে যানবাহন অনেক সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
গাড়ির মালিক ও চালক রণজিত সিংহ জানান, দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলতে নিজের সতর্কতা ও সচেতনতাই যথেষ্ট। দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করলে সারা জীবন অন্যের বোঝা হয়ে থাকতে হয়। তাই সকল চালকের উচিত গাড়ী চালানোর সময় গতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও সতর্কতা অবলম্বন করা।
সিএনজি অটোরিক্সা চালক শাহীন আহমদ জানান, সতর্কতার সাথে আর নিজের নিয়ন্ত্রণে গাড়ী চালালে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব।
সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টরা যা বলেন
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, একেকটি দুর্ঘটনা একেকটি পরিবারকে নিঃস্ব করে দেয়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে রাস্তায় চলার সময় সচেতন হতে হবে। ২০১৮ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে সড়ক নিরাপত্তা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। প্রয়োজনে নতুন সড়ক আইন প্রণয়ন করার কথা বলেন। তিনি বলেন, চালকদের সচেতনতার ওপর দুর্ঘটনা অনেকটা নির্ভর করে।
নিসচা’র সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক জহিরুল ইসলাম মিশু জানান, দেশে কঠোর সড়ক আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। আইন প্রয়োগ না হওয়ায় বিশেষ করে ট্রাক চালকরা বেপরোয়া গতিতে যানবাহন পরিচালনা করে।
২০২৩ সালের মাস ভিত্তিক দুর্ঘটনা
সিলেটের স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগে জানুয়ারী মাসে ১৮টি দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় ৩ নারী ও ৩ শিশুসহ নিহত হন ২৬ জন। এ মাসে আহত হন ২৬ জন। ফেব্রুয়ারী মাসে ১৭টি দুর্ঘটনায় ৩ নারী ও ২ শিশুসহ নিহত হন ২৩ জন। আহত হন ৩৬ জন। মার্চ মাসে ২২টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৫ নারী ও ১ শিশুসহ নিহত হন ২৬ জন। আহত হন ৬ জন। এপ্রিল মাসে ১৫টি দুর্ঘটনায় ৪ নারী ও ১ শিশুসহ নিহত হন ১৮ জন। আহত হন ৩৬ জন। মে মাসে ১১টি দুর্ঘটনায় ৬ নারী ও ২ শিশুসহ নিহত হন ১৭ জন। এ মাসে আহত হন ২১ জন। জুন মাসে ১৩টি দুর্ঘটনায় ১ শিশুসহ নিহত হন ৩১ জন। এ মাসে আহত হন ৫২ জন। জুলাই মাসে ১১টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ১ নারী ও ১ শিশুসহ নিহত হন ১৭ জন। এ মাসে আহত হন ৭ জন। আগস্ট মাসে ১০টি দুর্ঘটনায় ১ নারীসহ নিহত হন ৭ জন। এ মাসে আহত হন ১০ জন। সেপ্টেম্বর মাসে ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় ২ নারীসহ নিহত হন ২১ জন। এ মাসে আহত হন ৩১ জন। অক্টোবর মাসে ১৭টি দুর্ঘটনায় ২ নারী ও ১ শিশুসহ নিহত হন ২১ জন। এ মাসে আহত হন ৫৮ জন। নভেম্বর মাসে ১২টি দুর্ঘটনায় ১ নারী ও ১ শিশুসহ নিহত হন ১১ জন। এ মাসে আহত হন ১৭ জন। ডিসেম্বর মাসে ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় ৩ নারী ও ১ শিশুসহ নিহত হন ১৯ জন। আহত হন ১৫ জন। গত বছর সবচেয়ে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজারে। এ দুর্ঘটনায় ১৫ নির্মাণ শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন আরও অন্তত ১৪ জন। এছাড়া, কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়কে মাইক্রোবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিক্সার সংঘর্ষে ৭ জনের মৃত্যু হয়। সেপ্টেম্বর মাসে কোম্পানীগঞ্জ সড়কে জালালাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উবায়দুল্লাহ ইসহাক ও তার এক ব্যবসায়ী বন্ধু এবং বছরের শেষ দিকে এসে নগরীর হুমায়ুন রশীদ চত্বর এলাকায় নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজের রেজিস্ট্রার ডা: তৌহিদ উর রশীদ ও তার পুত্র তানহা রশীদের মৃত্যুর বিষয়টি সকলের হৃদয়ে দাগ কাটে।