এক বছরে ১৫১৩ নারী ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার
সিলেটে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১:০৬:২৬ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
নারীর প্রতি সহিংসতার যতগুলো ধরন আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো ধর্ষণ। সিলেট বিভাগে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে এই ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার মতো অপরাধ অন্য অপরাধগুলোকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
গত তিন বছরের পরিসংখ্যান বলছে, নারী নির্যাতন প্রতি বছর বছর পাল্লা দিয়ে বাড়ছেই। গত বছর সিলেটের চার জেলায় ১ হাজার ৫১৩ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬০০ জন। যা মোট নারী নির্যাতনের ঘটনার ৪০ শতাংশ। আর এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ১ হাজার ২২১ নারী। তারও আগের বছর ২০২১ সালে ৯১৩ জন নারী নির্যাতনের শিকার হন।
সিলেটের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে সিলেট বিভাগের নারী নির্যাতনের এই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন ও সামাজিক অঙ্গনে কাজ করছেন এমন আইনজীবীরা সিলেট বিভাগে নারী নির্যাতনের এমন পরিসংখ্যানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
জানতে চাইলে যৌন হয়রানি নির্মূলকরণ নেটওয়ার্ক সিলেটের আহবায়ক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী সিলেটের ডাককে বলেন, স্কুলের সামনের রাস্তায় বখাটেদের উৎপাত বেড়ে গেছে। এই চিত্র এখন কেবল শহরেই নয় গ্রামাঞ্চলেও। বখাটেদের যন্ত্রণায় মেয়েরা অতিষ্ট হয়ে উঠলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাণের ভয়ে বা লোকলজ্জার ভয়ে তারা মুখ খুলতে চাননা। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় নারী ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। এই যেমন সিলেটের এমসি কলেজে গৃহবধূ গণধর্ষণের মতো দেশে-বিদেশে আলোচিত ঘটনার বিচার কার্যক্রম এখনো শুরুই হয়নি। তাই সবকটি ঘটনার বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হলেই কেবল এসব ঘটনা কমে আসবে।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) সিলেটের সাবেক কো-অর্ডিনেটর এডভোকেট ইরফানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা শুধুমাত্র বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণেই বাড়ছে।
আদালতের মামলাজট প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিচার হতে অনেক সময় লেগে যায়, এ কারণে মামলা জটের সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে অপরাধীরা অপরাধ করতে আরও উৎসাহী হচ্ছে। আগের তুলনায় মানবিকতাও কমে গেছে। মানবিক আচরণ থেকেও মানুষ সরে যাচ্ছে। নারী ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো ভয়াবহ ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে দ্রুত ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছর সিলেট বিভাগে ৬০০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯১৩ নারী। আর ২০২২ সালে ৬২১ নারী ধর্ষণের শিকার হন। একই বছরে ৬০০ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
২০২১ সালে ৯১৩ নারী নির্যাতনের শিকার হন। তাদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৬০৯ জন নারী আর ৩০৩ জন নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
সিলেট রেঞ্জ ও সিলেট মহানগর পুলিশের আওতাভুক্ত এলাকার উপরোক্ত পরিসংখ্যান বলছে, সিলেট বিভাগে নারী ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা কেবল বেড়েই চলেছে।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ঘটেছে নারী ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা। সীমান্তবর্তী এলাকায়ও ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। ওই এলাকাসমূহে তুলনামূলক ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সদ্য বিদায়ী ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৩৭ নারী। ওই মাসেই ৪৮ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে ২৬ নারী ধর্ষণের শিকার আর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৫১ নারী। মার্চ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৪ জন নারী। একই মাসে ৫৮ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এপ্রিল মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫৬ জন নারী। ওই মাসে ৭১ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
মে মাসে ৭৫ নারী ধর্ষণের শিকার হন আর ওই মাসে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯৮ নারী। জুন মাসে ৫৮ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। একই মাসে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯০ নারী। জুলাই মাসে ৪১ নারী ধর্ষণের শিকার হন। ওই মাসে ৯৪ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আগস্ট মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৮ নারী আর ৯৫ নারী হন শারীরিক নির্যাতনের শিকার। সেপ্টেম্বর মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬০ জন নারী এবং ওই মাসে ৯৫ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অক্টোবর মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫৩ জন। একই মাসে ৮৫ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
নভেম্বর মাসে ৫৯ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর ওই মাসে ৭৭ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে ৪২ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। একই মাসে ৫২ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে ওসিসি সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৩৭ জন। ওই মাসে ৩১ নারী শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৪৫ জন আর ৩২ জন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। মার্চ মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৫২ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৫৫ জন, এপ্রিল মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৫৯ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৬৫ জন নারী। মে মাসে ৬০ জন ধর্ষণের শিকার হন এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৩৯ জন। জুন মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৪৭ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৩১ জন। জুলাই মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৫৪ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৭০ জন। আগস্ট মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৭০ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৭১ জন। সেপ্টেম্বরে ৫৩ জন ধর্ষণের শিকার হন আর ৪৪ জনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। অক্টোবর মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৬০ জন ও শারীরিকভাবে ৫৪ জন নির্যাতনের শিকার হন। নভেম্বর মাসে ধর্ষণের শিকার হন ৪৯ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৫৭ জন। আর ডিসেম্বর মাসে ৩৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। ওই মাসে ৫১ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।