বেপরোয়া চাঁদাবাজি ॥ সিলেট বন্ধের হুমকি ব্যবসায়ীদের
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৪:২২:৫৬ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
সিলেট বিভাগের পাইকারি ব্যবসার প্রধান হাট কালিঘাটে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে। কেবল কালিঘাটেই নয়; সবজির আড়তেও সমানতালে চলছে চাঁদাবাজি। খোদ পুলিশ সদস্যদের সামনেও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। কিন্তু, ভয়ে কেউ এ বিষয়ে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা সিলেট বন্ধ করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমদের অভিযোগ, আইনশৃংখলা বাহিনী চাঁদাবাজদের মদদ দিচ্ছে। চাঁদাবাজদের উৎপাতে ব্যবসায়ীরা যারপরনাই আতঙ্কিত। বেপরোয়া এই চাঁদাবাজির মাঝেই নগরের বিভিন্ন এলাকায় চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
সিলেটের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সিলেট নগরের কালিঘাটে বেপরোয়া চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে চাঁদাবাজির ঘটনা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সশস্ত্র চাঁদাবাজদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করারও সাহস পান না। প্রতিদিনই কালিঘাটে এমন ঘটনা ঘটছে। অনেকের অভিযোগ, কেবল কালিঘাটেই নয়; এমন চাঁদাবাজি হচ্ছে সিলেটের অন্যান্য পাইকারি হাটেও।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কালিঘাটে পেঁয়াজ ভর্তি ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি করা হয়। জৈন্তাপুর থেকে সবজি ভর্তি ট্রাকটি সিলেট নগরে প্রবেশের পর সেটি লুট করে নেয়া হয়। সুবহানিঘাট সবজির পাইকারি আড়তে আসা সবজি ভর্তি ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি করা হয়। চাহিদা মাফিক চাঁদা দেয়া না হলে সবজি লুট করে নেয়া হয়। কখনো ট্রাক নিয়ে যায়; আবার কখনো নিয়ে যায় টাটকা সবজি। সবজি লুটের ঘটনা অব্যাহত আছে জানিয়েছেন সোবহানিঘাট কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী কাজি মাসুদ।
কাজী মাসুদ আরও জানান, সিলেটের পাইকারি আড়তে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে সবজি নিয়ে আসা হয়। জৈন্তাপুর থেকে সবজি নিয়ে আসার পথে বটেশ্বর পার হওয়ার পরে, এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে কিংবা টুকেরবাজার থেকে সবজি নিয়ে আসার পথে গাড়িকে ফলো করা হয়। তাদের সুবিধা মতো জায়গায় এসে গাড়ি ছিনতাই করে নিয়ে যায়। অনেক সময় পুরো গাড়ি নিয়ে নেয়; আবার কখনো টাকা নেয়। এর ফলে বেপারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এভাবে চলতে থাকলে কাঁচামালের সংকট দেখা দিবে। অবিলম্বে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করার দাবি তার।
এদিকে, মাসের পর মাস ধরে এভাবে চাঁদাবাজি চললেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এই সুযোগে চাঁদাবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ।
এদিকে, চাঁদাবাজি দ্রুত বন্ধ করে এর সাথে সম্পৃক্ত চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিতে সিলেটের ব্যবসায়ীরা গত বৃহস্পতিবার সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার, সিলেটের জেলা প্রশাসক ও সিলেটের পুলিশ সুপারের নিকট পৃথক স্মারকলিপি দিয়েছেন। এতে তারা ৭ দিনের আলটিমেটাম দিয়ে বলেন, এই সময় চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে সিলেটের ব্যবসায়ীরা রাস্তায় নামবেন।
সিলেট বন্ধ করার হুমকি
সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটের কালিঘাটসহ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে চাঁদাবাজি চলছে তার সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমদ। এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাঁদাবাজদের মদদ দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা মদদ দিচ্ছে; এরা আমাদের দেশের শত্রু। দুই লাখ টাকার মাল আনলাম আর ৬০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে নিয়ে গেলেন, তাহলে তো আমার পুঁজি নিয়ে গেলেন। সিলেটে কোনো পণ্য উৎপাদন হয় না ; তাই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সড়ক পথ দিয়ে সিলেটে ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামাল নিয়ে আসতে হয়। কিছুদিন ধরে দেখা যায়, মালামাল নিয়ে আসার সময় সন্ত্রাসীরা গাড়ির চালককে ধরে কাগজপত্র, টাকা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় গাড়ি লুটপাট করে। সাম্প্রতিককালে কালিঘাট, কাজিরবাজার, ট্রেড সেন্টার, নওয়াব আলী মার্কেটেও হানা দিয়েছে চাঁদাবাজার। এদের কারণে ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। সন্ত্রাসী কোনো দলের নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সন্ত্রাসীর পরিচয় সন্ত্রাসী। এরকম কার্যকলাপ বন্ধ না হলে সিলেট বন্ধ হয়ে যাবে।
চুরি-ডাকাতি হচ্ছে মসজিদ-প্রবাসীর বাড়িতে
সিলেট নগরের ৩৬নং ওয়ার্ডের উত্তর বালুচরে লন্ডন প্রবাসী আইয়ূবুর রহমানের বাসায় গত শুক্রবার ভোররাতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও এর সাথে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশঙ্খলা বাহিনী। সাত-আটজনের সশস্ত্র ডাকাতদল আগ্নেয়াস্ত্র ধরে তাদের বাসা থেকে ৪০ ভরি স্বর্ণ, ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ড, নগদ টাকা, দামী কাপড়চোপড়, চারটি লাগেজ, মোবাইল সেটসহ প্রায় ৭০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় ওই প্রবাসীর পরিবার ও স্বজনদের মাঝে আতঙ্খ বিরাজ করছে। এ ঘটনায় বাসার কেয়ারটেকার আনা মিয়া বাদী হয়ে গতকাল শনিবার শাহপরান থানায় এজাহার দায়ের করবেন বলে জানিয়েছেন।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্যমতে, ডাকাতির ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী স্থানে গেল ২০ নভেম্বর ছাত্রলীগ কর্মী আরিফ আহমদকে প্রকাশ্যে দিবালোকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই এলাকায় ইতোপূর্বে একাধিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি রাতে নগরের আলমপুর গণপূর্ত জামে মসজিদে দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা ঘটে। মসজিদের ইমাম মাওলানা শামিম আহমদ জানান, চোরেরা রাতের আঁধারে মসজিদের প্রধান দরজা, দুটি গেইটের তালা কেটে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আইপিএসের ব্যাটারি, মাইকের মেশিন, তিনটি দানবাক্সসহ লক্ষাধিক টাকার মালামাল নিয়ে যায়। মসজিদের মাত্র বিশ গজ পাশেই আলমপুর পুলিশ ফাঁড়ি থাকলেও পুলিশ চোরদের খোঁজ পায়নি।
পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য
নগরীতে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি, চুরি ডাকাতির বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় সিলেটের ডাককে বলেন, চাঁদাবাজির বিষয়ে এসএমপি পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের নিকট ব্যবসায়ীরা স্মারকলিপি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে নগর পুলিশের সকল টিমকে চাঁদাবাজি রুখতে ও চাঁদাবাজদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে এসএমপি কমিশনার নির্দেশ দিয়েছেন। চাঁদাবাজির কোনো ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ওই এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশকেও বললে তারাও ব্যবস্থা নেবে।
চাঁদাবাজদের মদদ দেয়ার অভিযোগের ব্যাপারে তিনি জানান, চাঁদাবাজি একটি অপরাধ। এর সাথে যদি পুলিশের কোনো সদস্য সম্পৃক্ত থাকেন; তাহলে তার ছাড় নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, অপরাধে জড়ানো পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে স্বয়ং পুলিশ কমিশনার কঠোর বার্তা দিয়েছেন। আর লন্ডন প্রবাসীর বাসায় ডাকাতি ও মসজিদে চুরির ব্যাপারে বলেন, বালুচরের ঘটনাটি মূলত: চুরি। বাসার মালিক ঘটনার পরে লন্ডন চলে গেছেন। তাদের পক্ষ থেকে থানায় এজাহার দেয়ার কথা ছিল; গত রাত পর্যন্ত কেউ এজাহার দিতে আসেনি। আলমপুরের চুরির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত বলতে হবে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।