স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও চোরাচালান চক্রে সক্রিয়
জকিগঞ্জ সীমান্তে নির্বিঘ্নে চলছে ইয়াবা চোরাচালান
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ মার্চ ২০২৪, ১১:৪২:৩৩ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
সিলেট জেলায় দূরত্বের দিক দিয়ে সবচেয়ে দূরের উপজেলা জকিগঞ্জ। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তঘেঁষা অবস্থানের কারণে এই জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে অনেকটা নির্বিঘেœ চলছে ইয়াবা চোরাচালান। সীমান্তের কোনো না কোনো এলাকা দিয়ে প্রতিদিন দেশে ইয়াবার চালান ঢুকছে। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এমনকি গৃহবধূও সক্রিয় চোরাচালানে। মাঝে মধ্যে বড় চালান আটক হলেও চোরাচালান চক্রের মূল হোতারা ধরা না পড়ায় থামছে না এই অপকর্ম। জকিগঞ্জ সীমান্ত হয়ে আসা ইয়াবা সিলেট অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। সীমান্ত থেকে গন্তব্য পর্যন্ত বিস্তৃত শক্তিশালী চোরাচালান চক্র দমন না করায় দিন দিন এদের তৎপরতা বেড়েই চলছে।
জানতে চাইলে বিজিবি জকিগঞ্জ ক্যাম্প ইনচার্জ হাবিলদার তোতা মিয়া সিলেটের ডাককে বলেন, মাদক কারবারিরা রাতের আঁধারে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে ইয়াবা নিয়ে আসে। আমরা সবসময় এদেরকে ধরতে মাঠে থাকি। কিন্তু স্থানীয় লোকজন বিজিবিকে সহযোগিতা করেন না। এলাকার চোরাচালানি, মাদক কারবারিদের দেখিয়ে দিলে বা বিজিবিকে সহযোগিতা করলে সীমান্তে মাদক নির্মূল করা সহজ হতো। বিজিবি মাদকসহ চোরাচালান নির্মূলে কাজ করছে।
র্যাব-৯ এর মিডিয়া অফিসার সহকারী পুলিশ সুপার মো. মশিউর রহমান সোহেল বলেন, জকিগঞ্জ সীমান্তে ইয়াবার চালান আসে এমন খবরে র্যাব মাঠে নামে। বেশ কিছু দিন ধরে কাজ করার পরে নিশ্চিত হই চালান আসছে। এরপর মাদক কারবারি হুশাইর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ইয়াবার বড় চালান আটক করা হয়। আশপাশে সব ঘর টিনের তৈরি হলেও হুশাই সুরম্য দালান তৈরি করেছে। ইয়াবার অর্থ দিয়ে সে দ্বিতল বাড়ি নির্মাণ করেছে বলে র্যাব নিশ্চিত হয়েছে। জকিগঞ্জ সীমান্তের ওপর র্যাবের বিশেষ নজরদারি থাকবে।
সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপারেশন এন্ড ক্রাইম) শেখ মো. সেলিম বলেন, পুলিশ নিয়মিত ইয়াবাসহ মাদক নির্র্মূলে অভিযান পরিচালনা করে। মাঝে মধ্যে ইয়াবার চালান ধরা পড়ে। ইয়াবা চোরাচালান প্রতিরোধে পুলিশের নজরদারি আরও বাড়ানো হবে।
জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফের পরই জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে অনেকটা নির্বিঘেœ দেশে ইয়াবার চালান ঢুকছে। জকিগঞ্জ উপজেলার খলাছড়া ইউনিয়নের লোহারমহল, জকিগঞ্জ ইউনিয়নের বাখরশাল, ছবড়িয়া, সেনাপতিরচক, লালোপাড়া, সুলতানপুর ইউনিয়নের ইছাপুর, সুলতানপুর, অজরগ্রাম, সহিদাবাদ, ভক্তিপুর, বারঠাকুরী ইউনিয়নের পিল্লাকান্দী, আমলশীদ, বারঠাকুরী, উত্তরকুল, কসকনকপুর ইউনিয়নের আইওর, বিয়াবাইল, বিরশ্রী ইউপির বড়চালিয়া, পীরনগর, সুপ্রাকান্দী এলাকা দিয়ে নিয়মিত ইয়াবার চালান নিয়ে আসে চোরাকারবারিরা। বারঠাকুরী ইউপি সদস্য মুকুল আহমদ, সুলতানপুর ইউপির সাবেক সদস্য তাজ উদ্দিন তাজন, খলাছড়া ইউপির সাবেক সদস্য লিটন আহমদ, একই ইউপির সাবেক সদস্য শাহীন আহমদ ও শাহাব উদ্দিন,সুলতানপুর গ্রামের সুজন আহমদ, শফিক আহমদ, ময়নুল আহমদ, দেলোয়ার হোসেন সাগরের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে ইয়াবা চোরাচালানের বড় নেটওয়ার্ক। এদের সকলের বিরুদ্ধে মাদক মামলা রয়েছে। জকিগঞ্জ পৌর যুবলীগ নেতা শাহরিয়ার রহমানসহ অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মী, জনপ্রতিনিধিরা এমনকি অনেক গৃহবধূ- যুবতিও ইয়াবার কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন। মাঝে মধ্যে আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযানে কেউ কেউ আটক হলেও বেশিরভাগই ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়।
একটি সূত্র জানায়, জকিগঞ্জ পৌর এলাকার মাইজকান্দি গ্রামের মাদক কারবারি হুশাইর বাড়ি থেকে গত সোমবার বিকেলে ৪৭ হাজার ১০০ পিস ইয়াবার চালান আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৯)। এ ঘটনায় পেশাদার মাদক কারবারি হোসেন আহমেদ হুশাই (৩৫) ও সিরাজ উদ্দিনকে (৫১) আটক করে র্যাব। হুশাইর বিরুদ্ধে মাদক, চুরিসহ নানা অপরাধে ৫ টি ও সিরাজের বিরুদ্ধে ২ টি মামলা রয়েছে।
হুশাই বর্তমান সময়ে জকিগঞ্জে ইয়াবা চোরাচালানির একটি আলোচিত নাম। হুশাইর মতো জকিগঞ্জে আরও অনেক ইয়াবা চোরাচালানি এখনো নির্বিঘেœ মাদক কারবার করছে।
এর আগে গত ১০ জানুয়ারি বুধবার বিকেলে অ্যাম্বুলেন্সে করে পাচারকালে সিলেট- জকিগঞ্জ সড়কের গোলাপগঞ্জের চৌঘরি বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ৮০০ পিস ইয়াবার চালানসহ মাদক কারবারি আতাউর রহমান আতা (৫২), বেলাল আহমদ (৪৩) ও মাসুদ আহমদকে (৪২) আটক করা হয়।তাদের সকলেই জকিগঞ্জের বাসিন্দা। গেল ১৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দুপুরে বিশ্বনাথ পৌর এলাকার দূর্য্যাকাপন গ্রামের মাদক সম্রাট তুহিনের বাড়ির রাস্তা থেকে ৭৮০ পিস ইয়াবাসহ কল্পনা বেগম (৪৬) নামে এক নারী মাদক কারবারিকে আটক করে পুলিশ। আটক কল্পনা বেগম জকিগঞ্জ উপজেলার জালালপুর গ্রামের আবু সুফিয়ান খোকন মিয়ার স্ত্রী। ৩ সেপ্টেম্বর সিলেট নগরীর বটেশ্বর এলাকা থেকে সাড়ে ৫ হাজার পিস ইয়াবার চালানসহ রায়হান উদ্দিন নামের এক মাদক কারবারিকে আটক করা হয়। রায়হান জকিগঞ্জ উপজেলার খারিজা গ্রামের মৃত রইব আলীর পুত্র। ৩০ আগস্ট বুধবার বিকেলে নগরীর পীর মহল্লার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ১৫ হাজার ৬০০ ইয়াবাসহ ৩ জনকে আটক করে পুলিশ। আটককৃতরা হচ্ছে, জকিগঞ্জের মানিকপুরের মৃত মোজাম্মিল আলীর ছেলে মাহবুবুর রহমান (৪৫), বিশ্বনাথের পাঠাকইন এলাকার মৃত জাবেদ আলীর ছেলে আজির উদ্দিন (৩০) ও সুনামগঞ্জ জেলার জাহাঙ্গীনগর এলাকার শফিকুল ইসলামের পুত্র রাসেল আহমদ (৩২)।
২৫ এপ্রিল সোমবার রাতে নগরীর উপশহরের জি ব্লক থেকে ২ হাজার ১৫০ পিস ইয়াবাসহ দুলাল মিয়া ওরফে দুলাল আহমদকে (৩১) আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। দুলাল মিয়া ওরফে দুলাল আহমদ (৩১) নগরীর জালালাবাদ থানার টুকেরবাজার পূর্বদর্শা গ্রামের মৃত আবদুল করিমের পুত্র। সে জকিগঞ্জ থেকে পাইকারি দামে ইয়াবা কিনে এনে সিলেট নগরীতে বিক্রি করত। এর আগের বছর ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে জকিগঞ্জ পৌর এলাকার ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সামনে অভিযান চালিয়ে ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ রেহান উদ্দিন (৩৩) ও বাবুল আহমদকে (২৯) আটক করা হয়। তারা জকিগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার বিকেলে নগরীর শাহজালাল উপশহর থেকে ২৯ হাজার ইয়াবাসহ রোকসানা আক্তার নামের এক নারীকে আটক করে র্যাব-৯। আটক রোকসানা জকিগঞ্জ উপজেলার এওলাসার গ্রামের আব্দুল হামিদ চৌধুরীর স্ত্রী।
২০২০ সালের ২৩ জুলাই বৃহস্পতিবার ভোরে বিশ্বনাথের শিমুলতলা গ্রামে অভিযান চালিয়ে ৩০ হাজার পিস ইয়াবাসহ মাদক কারবারি খালেদ মিয়াকে আটক করা হয়। জকিগঞ্জে প্রথমবারের মতো ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর ৬১ হাজার ৪০০ ইয়াবার বড় চালান উপজেলার সীমান্তবর্তী মানিকপুর ইউনিয়নের সেনাপতিরচক এলাকায় অভিযান চালিয়ে আটক করে বিজিবি। কিন্তু কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। এর আগে সিলেটে ইয়াবার এত বড় চালান কখনো আটক হয়নি।