রেলস্টেশন এলাকায় সওজ’র জায়গা দখলে ঢাল মসজিদ!
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মার্চ ২০২৪, ২:২৪:১২ অপরাহ্ন
কাউসার চৌধুরী :
সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান ফটকের ঠিক ডান পার্শ্বে মসজিদের নামে সড়ক বিভাগের ভূমি দখল করে নিয়েছে একটি চক্র। ভূমি দখলের পর ‘সিলেট বাস রেল স্টেশনযাত্রী ৩৬০ আউলিয়াল্লাহ মসজিদ’ নামে একটি সাইনবোর্ডও টানানো হয়েছে। প্রথম দফায় রেলওয়ের বাধায় সফল না হলেও এবার চক্রটি পুরোদমে দখলে নিয়েছে। মাহমুদুল্লাহ মাদানি নামের এক ব্যক্তি নেতৃত্বে থাকলেও কামাল উদ্দিন এবং নাসির উদ্দিন নামের স্থানীয় দুই ব্যক্তি এর নেপথ্যে কাজ করছেন। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
মসজিদ নির্মাণ প্রসঙ্গে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কি নির্দেশনা আছে জানতে চাইলে সিলেটের অন্যতম ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া মাহমুদিয়া সুবহানিঘাট মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস মাওলানা মুফতি হারুন রশীদ সিলেটের ডাককে বলেন, শরীয়তের দৃষ্টিতে মসজিদ করতে হলে আগে মসজিদের নামে জায়গা ওয়াকফ্ করে দিতে হবে অথবা জায়গার মালিকের পরিষ্কার অনুমতি থাকতে হবে। ওয়াকফ্ ছাড়া মসজিদ হয় না। সরকারের কোনো ভূমিতে মসজিদ নির্মাণ করতে হলে আগে ওই ভূমি নির্দিষ্ট করে মসজিদের নামে ওয়াকফ্ করে দিতে হবে। অথবা ভূমির মালিকের পক্ষ থেকে পরিষ্কার নামাজ পড়ার অনুমতি থাকতে হবে। না হয় সরকারি কিংবা বেসরকারি ভূমি জবর দখল করে মসজিদ তৈরি করলেও এটি মসজিদ বলে গণ্য হবে না।
এ বিষয়ে সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, নরসিংদির বাসিন্দা এক লোক কয়েক দিন আগে সিলেট রেল স্টেশনের প্রবেশ পথের ঠিক উত্তর পাশে ড্রেনের উপরে কয়েকটি বাঁশের খুঁটি গেড়ে নামাজ পড়ার স্থান তৈরি করেন। এ সময় আমরা তাকে নিষেধ করি। এক পর্যায়ে তার মালসামানা তুলে নিয়ে আসা হয়। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, উক্ত জমির মালিক সড়ক বিভাগ। এখন সড়ক বিভাগকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সিলেট সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন বলেন, রেলওয়ে স্টেশনের প্রবেশপথে সড়ক বিভাগের ভূমিতে নামাজের জন্যে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে বলে আমাদের কাছে খবর এসেছে। খবরটি শোনার পর আমরা লোক পাঠিয়ে তাদেরকে এটি সরিয়ে নিতে বলেছি। সরকারি ভূমি দখল বা এতে কোনো স্থাপনা তৈরি করা আইনত অপরাধ। এভাবে তারা সামিয়ানা টানাতে পারে না। যদি তারা নিজেরা এটি সরিয়ে না নেয় তাহলে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হবে। মসজিদ তো ইচ্ছে করলেই যেকোনো জায়গায় তৈরি করা যায় না। এটি সড়ক বিভাগের নিজস্ব জায়গা। এখানে মসজিদ তৈরি বা কোনো কিছু করার এখতিয়ার কারও নেই।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ২৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌফিক বক্স লিপন বলেন, কিছু সময় আগে একজনের কাছ থেকে এই ভূমিতে মসজিদ তৈরির বিষয়টি শুনলাম। এসব আসলে ভুয়া। হয়তো তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
অবশ্য অভিযুক্ত মাহমুদুল্লাহ মাদানি বলেন, মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্যেই এই জায়গায় সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। আমি জায়গা দখল করিনি। আবার জায়গা দখল করলেও তো যে কেউ এসে উচ্ছেদ করতে পারবে না। আগে নোটিশ দিতে হবে। তারপর উচ্ছেদের বিষয় আসবে। রেলের লোকজন তাদের অনুমতি না নেয়ায় সামিয়ানা নিয়ে গিয়েছিল। মসজিদ যে কেউ যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে তৈরি করতে পারে।
জানা গেছে, গত কিছুদিন ধরে একটি চক্র মসজিদের নামে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ২৬নং ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের ঠিক সামনের ভূমি দখল করতে নানান ফন্দি আঁটছিল। এর সূত্র ধরে কয়েক দিন আগে মাহমুদুল্লাহ মাদানি হঠাৎ করেই ড্রেনের উপর কয়েকটি বাঁশের খুঁটি গেড়ে নামাজ পড়ার স্থান তৈরি করেন। উপরে থ্রিপল টানানো হয়। আর নিচেও বিছানো হয় থ্রিপল। এরপর থেকে এখানে প্রায়ই দু-চারজন লোক নামাজ আদায় করছেন। যে জায়গায় নামাজ আদায় করা হয় এর ঠিক সামনেই প্রশ্রাবের দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বামে ড্রেন আর ডানেও প্রশ্রাবের দুর্গন্ধ।
সরেজমিনে গিয়েও এমন বিকট অবস্থা প্রত্যক্ষ করা গেছে। কাঁটাতার দিয়ে বেড়া দেয়া আছে। কাঁটাতারের অভ্যন্তরেই ময়লার বাগাড়ে তৈরি করা হয়েছে নামাজের স্থান। আবার এর সামনে মসজিদের সাইনবোর্ডও টানানো হয়েছে। সাইনবোর্ডের পাশেই দেয়া হয়েছে একটি দান বাক্সও।
একটি সূত্র জানিয়েছে, মসজিদ নির্মাণের জন্যে কামাল উদ্দিন ও নাসির উদ্দিন নামের স্থানীয় দুই ব্যক্তি চেষ্টা করছেন। তাদের সাথে এলাকার লোকজন আছেন বলেও জানিয়েছেন কামাল উদ্দিন। গতকাল বিকেলে তিনি এ প্রতিবেদককে ফোন দিয়ে বলেন, মসজিদ নির্মাণ করতে তাদের কাছে যথাযথ কাগজপত্র আছে। সড়ক বিভাগের ভূমিতে কোনো অনুমতি ছাড়া কিভাবে মসজিদ হয়, এমন প্রশ্ন করলে তিনি এ প্রতিবেদককে তার সাথে দেখা করতে বলেন।
অন্যদিকে, ময়লার বাগাড়ে মসজিদের মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড দেখে লোকজনকে হাসাহাসিও করতে দেখা যায়। মহিউদ্দিন নামের রেলওয়ের এক যাত্রী বলেন, দেখে মনে হচ্ছে ভূমি দখলের কৌশল হিসেবেই মসজিদের সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। মসজিদ নির্মাণ করতে হলে একেবারে নির্ভেজাল জায়গা লাগবে। এটা তো সরকারের জায়গা। এর মালিক দেশের জনগণ। বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। যাতে ভবিষ্যতে ধর্মের নামে এমন অধর্মের কাজ কেউ করতে না পারে।
কাদির মিয়া নামের আরেক যাত্রীর মন্তব্য, একশ্রেণির অসৎ লোক সারাদেশে সড়ক ও জনপথ এবং রেলওয়ের ভূমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ করে। তারা মার্কেট তৈরির আগে মসজিদের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়। তিনি বলেন, সিলেট রেলস্টেশন ফটকের সামনে মসজিদের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সরকারি জায়গা জবর দখলে যারা ফন্দিফিকির করছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা জরুরি।
মাহমুদুল্লাহ মাদানি জানিয়েছেন, তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী সদরের কলেজ এলাকার ব্রাহ্মণদিতে। তার পিতার নাম হাবিবুল্লাহ মাস্টার। তিনি নরসিংদির চরসুরতি মাদ্রাসা থেকে কামিল পাশ করেছেন বলে দাবি করেন।
প্রসঙ্গত, প্রায় দেড় দশক আগে আম্বরখানা-কুমারগাঁও সড়কের আখালিয়ায় সড়ক বিভাগের ভূমিতে একটি পাকা দালানের মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সড়ক বিভাগ অবৈধ উচ্ছেদ অভিযানকালে ওই মসজিদটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়।