হবিগঞ্জে ৫ দশকে নদীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমেছে ॥ বাকিগুলো সংকটে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১:২৮:২৪ অপরাহ্ন

হবিগঞ্জ থেকে মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল : নদীর উজানে সীমান্তের ওপারে নদীতে ব্যারেজ, বাঁধ নির্মাণ, নদীতে পলি পড়া, অবৈধ দখল, শিল্প দূষণসহ নানা কারণে হবিগঞ্জের নদীগুলো এখন অস্তিত্ব সংকটে। গত ৫ দশকে নদীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। হারিয়ে গেছে অনেক নদী। খর¯্রােতা নদীগুলো হারিয়েছে স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও নাব্যতা।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ে জেলায় নদীর সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান, বর্তমানে জেলায় প্রায় ২৫টি নদীর তথ্য পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য নদীগুলো হচ্ছে- খোয়াই, করাঙ্গী, সুতাং, সোনাই, কুশিয়ারা, বিজনা, রতœা, সুটকি, ঝিংড়ী, বিবিয়ানা, ভেড়ামোহনা, শাখাবরাক, ধলেশ্বরী, খাসটি, ঘুঙ্গিয়াজুরী, গোপলা, মরা কুশিয়ারা।
এদিকে, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশের ১ হাজার ৮টি নদ-নদীর তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে হবিগঞ্জ জেলায় ৪৩টি নদীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রুহুল হাসান শরীফ জানান, এক সময় খোয়াই নদী দিয়ে বড় বড় মালবাহী নৌকা ও লঞ্চ চলাচল করলেও বর্তমানে তা সম্ভব নয়। সীমান্তের ওপার থেকে প্রবাহিত জেলার প্রধান নদী খোয়াই বর্তমানে তার খর¯্রােতা রূপ হারিয়েছে। নদীর উজানে ভারতের চাকমা ঘাট নামক স্থানে ব্যারেজ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করায় শুকনো মৌসুমে বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচ কার্য ও নৌ চলাচল ব্যাহত হয়।
জানা যায়, হবিগঞ্জ শহরকে খোয়াই নদীর গ্রাস থেকে রক্ষাকল্পে ১৯৭৭-৭৮ সালে স্বেচ্ছাশ্রমে মাছুলিয়া থেকে রামপুর পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁককাটা (লুপকাটিং) প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। এতে খোয়াই নদী শহর থেকে পূর্ব দিকে সরে যাবার পর নদীর পুরাতন অংশে শুরু হয় অবৈধ দখল ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা নির্মাণ। দীর্ঘদিনেও এ সকল অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম সফল হয়নি। পরবর্তীকালে বৃহত্তর খোয়াই নদী প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও নদীটির স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ফিরে আসেনি।
এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সুতাং নদী শিল্পদূষণে দৈন্যদশাগ্রস্ত। নদী তীরের মানুষ এখন চরম বিপাকে। অস্তিত্ব সংকটে বিপন্ন মাধবপুর উপজেলার সোনাই নদীতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য পড়ে পানি দূষিত হচ্ছে। এই দূষিত পানি খাসটি নদী হয়ে চলে যাচ্ছে মেঘনা নদীতে। নদীগুলো সময়মতো খনন না করা, নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলন করায় করাঙ্গী, বিজনা, ভেড়া মোহনা, বিবিয়ানা, সুটকি, রত্মা, শাখাবরাক, বছিরা, হাঙ্গর ভাঙা নদীতেও পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় স্বাভাবিক নৌ চলাচল ও সেচ কার্য বিঘিœত হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল জানান, ১৯৭১ সালে জেলায় ৭০টি নদ-নদীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। গত ৫ দশকে এই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। বর্তমানে এগুলোও সংকটাপন্ন।
লাখাই উপজেলার বুল্লা গ্রামের সমাজকর্মী বাহার উদ্দিন জানান, শিল্পদূষণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সুতাং নদী তার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য ছিলো অপরিহার্য্য।
নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর কলেজের অধ্যক্ষ ও রিভার উইংস, নবীগঞ্জের আহ্বায়ক তনুজ রায় জানান, দখল-দূষণের কারণে নবীগঞ্জ উপজেলার নদীগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। বিভিন্ন নদীকে প্রকল্পের নামে খাল বানানো হচ্ছে।
মাধবপুর উপজেলার একতিয়ারপুর গ্রামের পরিবেশকর্মী আব্দুল কাইয়ুম জানান, স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ না থাকা ও শিল্পদূষণের কারণে মাধবপুর উপজেলায় অনেক নদী অস্তিত্ব সংকটে।
জেলা বাপা সভাপতি অধ্যক্ষ ইকরামুল ওয়াদুদ জানান, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য নদীরক্ষার বিকল্প নেই।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান, জেলার নদীগুলোর নাব্যতা ও পানির ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সেচ সুবিধা ও নৌ যোগাযোগ অব্যাহত রাখার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ৫শ ৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেজিংসহ প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
চলতি মৌসুমে সোনাই, করাঙ্গী, খাসটি এবং বিজনা নদী আংশিকভাবে এস্কেভেটর ও ড্রেজার দিয়ে পুণঃ খনন করা হয়েছে। প্রকল্পের অধীনে কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজও অব্যাহত রয়েছে। ৭.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রকল্পের সংশোধিত কাজ হিলাল নগর-মার্কুলী বাজার-দিগলবাক পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হবে। এছাড়াও বাঁধ নিমাণের ফলে বিবিয়ানা পাওয়ার প্ল্যান্ট এলাকা নদীভাঙন থেকে রক্ষা পাবে।
তিনি আরো জানান, ১৪শ’ ২৩ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে খোয়াই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ, ড্রেজিং এবং বাঁধ পুনরাকৃতিকরণসহ একটি বড় পরিকল্পনার প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ দল কর্তৃক প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।