ফেঞ্চুগঞ্জের শাহজালাল সারকারখানা
গ্যাস সংকটে বন্ধ উৎপাদন, ফের চালু নিয়ে অনিশ্চয়তা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৮:৫২ অপরাহ্ন
নূর আহমদ :
ইউরিয়া সার উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (এসএফসিএল) এর। জালালাবাদ গ্যাস কর্তৃপক্ষ গত ১৩ মার্চ থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এতেই বিপাকে পড়েছে দেশের বৃহৎ ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে, জালালাবাদ গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে এসএফসিএল এর জন্য বর্তমানে গ্যাস সরবরাহের বরাদ্দ নেই, তাই বন্ধ করা হয়েছে। ফলে শাহজালাল সারকারখানা ফের কবে চালু হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, এসএফসিএল এর কাছে জালালাবাদ গ্যাসের পাওনা প্রায় ৭৭৯ কোটি টাকা। যার জন্য এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে শাহজালাল সার কারখানার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। চার হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ কারখানার কাজ শেষ হয় ২০১৫ সালে। প্রকল্পে চীনের ঋণ ব্যবহার করা হয় তিন হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। ফলে চীনের শর্ত অনুযায়ী চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কমপ্ল্যান্ট এ কারখানা নির্মাণ করে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারখানাটি বিসিআইসির কাছে হস্তান্তর করে। হস্তান্তরের তিন মাসের মধ্যে বিসিআইসির অধীনে গঠন করা হয় শাহজালাল সার কারখানা কোম্পানি। একই বছরের ১৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের রাষ্ট্রপতি শিং জিন পিংকে সঙ্গে নিয়ে এর উৎপাদন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। যাত্রার পর থেকে কখনোই উৎপাদন লক্ষ্যমাত্র অর্জন করতে পারেনি কারখানাটি। শুরু থেকেই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বার বার ব্যাহত হয় উৎপাদন।
প্রতিদিন ১ হাজার ৭৬০ টন ইউরিয়া উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন এ কারখানা প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৪৫০ টন করে ইউরিয়া উৎপাদন করতে পারে। এ ছাড়া উপজাত হিসেবে উৎপাদন হচ্ছে তরল এমোনিয়া। কিন্তু নানা জটিলতা ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইউরিয়া সার উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়নি। সর্বশেষ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে দুই দফা বন্ধ শেষে এবার গত ১৩ মার্চ গ্যাস সংকটে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে সারকারখানাটি। ফলে উৎপাদনক্ষম শাহজালাল সারকারখানা জ্বালানি সংকটে বন্ধ রাখার ফলে অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এছাড়া চলতি অর্থবছর শাহজালালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিল ৩ লাখ ৮০ হাজার টন। মার্চ পর্যন্ত এ কারখানায় উৎপাদন হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার টন। চলমান সংকট দূর না হলে শুধু উৎপাদন যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও সিলেটের সিনিয়র সাংবাদিক মুজিবুর রহমান জকন বলেন, পুরাতন সারকারখানার পাশে নতুন এই কারখানা স্থাপন ছিল এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি। কিন্তু কারখানাটি স্থাপনের পর থেকে একের পর এক সংকট লেগেই আছে। যান্ত্রিক ত্রুটিসহ নানা কারণে বছরের একাধিক সময়ে উৎপাদন বন্ধ থাকে। এরমধ্যে নতুন সংকটে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিনি দেশে সারের চাহিদা বিবেচনা করে প্রতিষ্ঠানটি বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
অন্যদিকে উৎপাদনে যাওয়ার পর থেকেই লোকসান গুণছে শাহজালাল সারকারখানাটি। শাহজালাল সারকারখানার জিএম (অ্যাকাউন্ট) মো: আব্দুল বারিক এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি না হলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, নির্মাণের পর এ পর্যন্ত শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি সরকারের কোষাগারে সার বিক্রি করে অর্থ জমা দিয়েছে ৫৫৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে জুন ২০২২ থেকে সর্বশেষ উৎপাদন হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জালালাবাদ গ্যাস কর্তৃপক্ষ শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের কাছে বকেয়া পাওনা পাবে ৭৭৯ কোটি টাকা।
শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটিডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: জিয়াবুল হোসেন বলেন, গ্যাসের মূল্য ইউনিট প্রতি ৪ টাকা থেকে ১৬ টাকা করা হয়েছে। শাহজালাল সারকারখানায় বর্তমানে প্রতিটন সার উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় ৩৬ হাজার টাকা। কিন্তু সরকার নির্ধারিত প্রতিটন সারের বিক্রয় মূল্য ২৫ হাজার টাকা। প্রতি টনে প্রায় ১১ হাজার টাকা ঘাটতি। অন্তত এই ঘাটতি কীভাবে পুষিয়ে নেয়া যায় সেই চেষ্টায় শিল্প, কৃষি এবং অর্থ মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, গ্যাসের মূল্য ইউনিট প্রতি ৪ টাকা দর দিয়ে উল্লেখিত ঘাটতি, এর বেশি দিলে সারকারখানার ফান্ডে কোনো টাকাই থাকবে না।
মো: জিয়াবুল হোসেন আরো বলেন, বর্তমানে কারখানাটিতে কোন যান্ত্রিক ত্রুটি নেই। শুধুমাত্র গ্যাসের জন্য উৎপাদন বন্ধ আছে। গ্যাস পেলেই পুনরায় উৎপাদন শুরু হবে। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগোযোগ করা হচ্ছে। তিনি জানান, জালালাবাদ গ্যাসের পাওনা প্রায় ৭শ’ কোটি টাকার উপরে। ওই টাকা কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সমন্বয় করার চেষ্টা চলছে। সচিব পর্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। গত মঙ্গলবার ঢাকায় সচিবালয়ে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সার কারখানার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে প্রতিকার চেয়েছেন বলে জানান সারকারখানাটির এমডি।
জালালাবাদ গ্যাস টি এ্যান্ড ডি সিস্টেম লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (বিপণন উত্তর) প্রকৌশলী লিটন নন্দী বলেন, শাহজালাল সারকারখানায় বর্তমানে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে গ্যাস সরবরাহের জন্য সঞ্চালন লাইনে কোন অসুবিধা নেই। লেনা দেনা সম্পর্কিত কোন সমস্যা থাকলে সেটা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে এবং নির্দেশনা আসলে পুনরায় সরবরাহ শুরু হবে বলে জানান তিনি।