অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন থাকবে : আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে চাই : ড. ইউনূস
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ৪:১৯:১৩ অপরাহ্ন
দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে ব্রিফিং
আটকে পড়া ১৮ হাজার শ্রমিকের বিষয়ে বিবেচনা করবে মালয়েশিয়া
ডাক ডেস্ক : দুর্নীতি দমন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায় বিচার নিশ্চিতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টায় পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেই রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা সেরে ঢাকার একটি হোটেলে ইউনূসের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন ইব্রাহিম। পরে দুই নেতা যৌথভাবে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হন।
দুই নেতার কথায় পারস্পরিক সৌহার্দ্য এবং সহযোগিতার সদিচ্ছার বিষয়টি বার বার ফুটে ওঠে। প্রবীণ রাজনীতিক আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে আলাপচারিতায় ৮৪ বছর বয়সী ইউনূস রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজের ‘অনভিজ্ঞতার’ প্রসঙ্গ তুললে ‘দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার সামনে এটা কোনো বিষয় নয়’ বলে মন্তব্য করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ার ইব্রাহিম জানান, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে এবং আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।
টিকেট জটিলতার কারণে মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা ১৮ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিষয়ে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রথম পর্যায়ে ১৮ হাজার বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আশিয়ানের চেয়ারম্যান হতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া। সেজন্য ইউনূস প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে বৈঠকে অভিনন্দন জানান। আশিয়ানের খাতভিত্তিক আলোচনায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন তিনি। ইব্রাহিম প্রতিশ্রæতি দেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি সেই চেষ্টা করবেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় মালয়েশিয়ার সমর্থন পাওয়ার বিষয়টি স্মরণ করে অধ্যাপক ইউনূস সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আলোচনায় আমরা দীর্ঘদিনের দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো আরও প্রাণবন্ত করার বিষয়ে একমত হয়েছি। আমি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘটনাটি বর্ণনা করেছি। এই দ্বিতীয় স্বাধীনতার অন্বেষায় তরুণদের আত্মদানের বিষয়টি স্মরণীয়। তারা বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশের জন্য লড়েছে।
জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকার কাজে হাত দিয়েছে। ঐতিহাসিক এমন মুহূর্তে ভ্রাতৃপ্রতীম রাষ্ট্র মালয়েশিয়ার অবিরাম সমর্থনের জন্য আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রতিশ্রæতি পুনর্ব্যক্ত করেছি।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সহযোগিতার তিনটি প্রধান ক্ষেত্র নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলাপ করেছি। রাজনীতি, ব্যবসা-বিনিয়োগ, সংস্কৃতি ও মানবিক সহায়তা। জোর করে বাস্তুচ্যুত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের নিরাপদে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি আমরা আলোচনা করেছি। আশিয়ানের ফোরামে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি জোরের সঙ্গে তোলার জন্য মালিয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি।
“পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায় এবং পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে নিয়মিত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার গুরুত্ব নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট করার জন্য ট্রেড নেগোশিয়েশন কমিটির বৈঠক শুরুর আশা করছি। কৃষি, জ্বালানি, শিক্ষা, হালাল অর্থনীতি, সেমি কন্ডাক্টর ইন্ড্রাস্ট্রি, কানেক্টিভিটি, বøু ইকনোমি, বিজ্ঞান, উদ্ভাবন, প্রতিরক্ষা ও যুব উন্নয়নের বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার নতুন নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলেছি।”
সেবাখাতে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সেবা খাত দুই দেশের জন্য সম্ভাবনাময় একটি খাত। এই খাতে দুই দেশের জন্য লাভজনক বিষয়গুলো নিয়ে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারি। ভবিষ্যতে সহযোগিতার আরও দুটি খাত হতে পারে মোবিলিটি ও ফাইন্যান্সিং।
“দুই দেশের অর্থনীতিতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবদানের স্বীকৃতিতে ২০২২ সালে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিয়ে করা এমওইউর বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বাংলাদশে থেকে পেশাদার ও শ্রমিক নেওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়েও কথা হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বিনিময়, ফ্যাকাল্টি এক্সচেঞ্জসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলাপ হয়েছে। গভীর সমুদ্রের মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাংয়ের মধ্যে কৌশলগত কানেক্টিভিটির বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পেয়েছে।
দুই নেতার বৈঠকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়ার চলমান কর্মসূচিগুলো কার্যকর করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়।
‘নতুন’ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে ‘বিপ্লব’ ও ’সংগ্রাম’ শব্দগুলো বাংলায় উচ্চারণ করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে আগে ফোন করে সমর্থন জানানোর কথাটিও তিনি বলেন।
জেল জীবনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি পড়ে বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কথা সংবাদ সম্মেলনে বলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। আর অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে চার দশকের পরিচয়ের কথাও তুলে ধরেন।
ইউনূস সরকার পরিচালনায় নিজেকে ‘অনভিজ্ঞ’ বলায় ইব্রাহিম তাকে বলেন, “আপনার সক্ষমতা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আপনার দীর্ঘ প্রচেষ্টার কাছে এই অনভিজ্ঞতা কোনো ব্যাপার না। আমি মনে করি, আজকের পৃথিবীতে এটারই অভাব সর্বত্র। আজকে ফিলিস্তিনের গাজা ও লেবাননের দিকে তাকালে কী দেখা যায়? মানবতা ও ন্যায়বিচারের অভাব।”
ব্যবসা ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, “এখানে মালয়েশিয়ার কোম্পানি আছে, সেখানেও বাংলাদেশিদের বিভিন্ন কোম্পানি রয়েছে। এখানে আরও কার্যকর অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব প্রয়োজন।
“কোম্পানিগুলোর দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রæত যেন সমাধান হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। অর্থনীতির মূল বিষয়গুলো এবং দুর্নীতির ক্ষেত্রে দুই দেশের সরকারের বিশেষ গুরুত্বের বিষয়টি কোম্পানিগুলো দেখছে। দুর্নীতির বিষয়ে আমরা কোনো ছাড় দেব না।
“শিক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়টিও আমরা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে পারি। এ বিষয়ে আরও আলোচনা হতে পারে।”
আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হিসাবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হবেন বলে প্রতিশ্রæতি দেন প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার।
ইউনূসের সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রæতি দিয়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, “নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য আপনার প্রচেষ্টার বিষয়ে আমার আস্থা আছে। নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার বিষয়ে আপনার প্রচেষ্টাও আমি বিশ্বাস করি।”