হাওরে কোটি টাকার গর্ত ভরাট প্রকল্প : নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ মে ২০২৫, ১০:৩৩:২৭ অপরাহ্ন

শহীদনূর আহমেদ, সুনামগঞ্জ থেকে : সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধের পাশে ‘কোর’ বা গর্ত ভরাট (ডিচ ফিলিং) প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে চললেও অনেক হাওরে শুরু হয়নি কাজ। জলমহাল ইজারাদার ও জমির মালিকদের বাধাসহ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নানা অজুহাতে অনিশ্চিয়তার মুখে ২৪ কোটি টাকার গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি। ফসলরক্ষা বাঁধ টেকসই, জীববৈচিত্র্য ও গোচারণ ভূমি রক্ষায় দ্রুত সময়ে কাজ বাস্তবায়নের দাবি হাওর পাড়ের কৃষকদের।
জানা যায়, পাহাড় থেকে আসা প্রবল পানির স্রোতে বাঁধ ভেঙে হাওরে প্রবেশ করে বাঁধের কিনারে সৃষ্টি করে বড় বড় গর্ত। আর এই গর্তের কারণে প্রতিবছর ফসলরক্ষা বাঁধের সুরক্ষা নিয়ে দুঃশ্চিতায় থাকতে হয় কৃষকদের। তাই, বাঁধের পাশের গভীর গর্তের কারণে যাতে ফসলরক্ষা বাঁধ বর্ষায় বা আগাম বন্যার ঝুঁকিতে না পড়ে সেই উদ্দেশ্যে জরুরি বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ পুনঃনির্মাণ সহায়তা প্রকল্পের আওতায় জেলার দশ উপজেলায় চারটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মাটি ভরাটের কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তার মধ্যে রাজধানী ঢাকার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এসএস বিল্ডার্স সাড়ে ৫ কোটি টাকা, টাঙ্গাইলের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ ৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা, রাজধানী ঢাকার শাহ ড্রেজার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ৩ কোটি টাকা ও নেত্রকোণার অসীম সিংহ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকার কাজ করছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নেওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ চলতি মে মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো অনেক হাওরে কাজই শুরু করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। হাওরে জলমহাল ইজারাদারদের নিষেধাজ্ঞা, জমির মালিকদের বাধা ও বরাদ্দ জটিলতার কারণসহ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বেখেয়ালিপানায় অনিশ্চয়তায় পড়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি।
নদী থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বিটবালু দিয়ে গর্ত (ডিচ ফিলিং) ভরাটের কথা থাকলেও বেশিরভাগ হাওরে জলমহাল ইজারাদারদের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের। কোথাও কোথাও কাজ শুরু করা হলেও ইজারাদার ও ফসলি জমির মালিকদের বাধার মুখে কাজ ফেলে রেখে আসতে হয়েছে সংশ্লিষ্টদের।
এদিকে, প্রকল্পের এমন অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ত ভরাট না হলে বাঁধের স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন কৃষকরা।
সরেজমিনে তাহিরপুর উপজেলার বড়দল গ্রামে আলমখালি স্থায়ী বাঁধে গিয়ে দেখা যায় বাঁধের কিনারে কিছু কিছু স্থানে বিট বালি ফেলা রয়েছে। তবে গর্ত ভরাট কাজ অসম্পূর্ণ থাকতে দেখা গেছে। এই এলাকায় আরও দুইটি স্থানে গর্ত ভরাটের কথা থাকলেও এখনো কাজ শুরু করেনি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
কৃষকরা জানিয়েছেন, ড্রেজার মেশিন দিয়ে আলমখালীতে কিছুদিন মাটি ফেলার পর সবকিছু নিয়ে চলে গেছে ঠিকাদারের লোকেরা। কি কারণে কাজ না করে তারা চলে গেছে এ বিষয়ে কেউ জানেনা।
বড়দল গ্রামের সাদিকুর রহমান বলেন, কিছু দিন আগে দেখেছি বালি ফেলে গর্ত ভরাট করা হচ্ছে কিন্তু আবার সবকিছু বন্ধ করে তারা চলে গেছে। গর্ত ভরাট বাঁধের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাঁধের পাশের গর্তের কারণে বাঁধ ঝুঁকিতে থাকে। নদীতে পানির চাপ বাড়লে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তরিকুল নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, সরকার টাকা দিছে গর্ত ভরাট করতে কিন্তু গর্ত ভরাট হয়নি। শুনেছি জলমহাল ইজারাদার নাকি মাটি ভরাটে বাধা দিয়েছে। তারা কি কারণে বাধা দিয়েছে তা আমাদের জানা নেই। তবে মাটির গর্ত ভরাটে কৃষকদের পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
তবে আলমখালি মাটি ভরাট কাজের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গুডম্যান এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি ভজন তালুকদার জানান, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে চেষ্টা রয়েছে তাদের কিন্তু জলমহাল মালিকদের বাধার মুখে অনেক স্থানে কাজ করতে পারছেন না তারা। কোথাও কোথাও কৃষকরাও বাধা দিচ্ছেন। কৃষকরা বলছে বিট বালিতে তাদের জমি নষ্ট হবে। এই অবস্থায় কাজ বাস্তবায়ন করতে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন বলে জানান ভজন তালুকদার।
হাওরের বাঁধের গর্ত ভরাট (ডিচ ফিলিং) প্রকল্প শেষ না হওয়ায় ও সরকারি টাকা গচ্ছা যাওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়ে হাওর বাঁচাও আন্দোলন জেলা কমিটি সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক মিলন বলেন, মাটি ভরাট প্রকল্পের অগ্রগতি অন্তোষজনক। হাওরের যেসকল গর্ত ভরাটে জন্য প্রাক্কলন করা হয়েছে তার কিছু কিছু গর্ত জলমহাল মালিকদের ইজারায় থাকায় তারা বাধা দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের গাফিলতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুষ্ঠু সমন্বয় না হলে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। মাঝ পথে সরকারের এতোগুলো টাকা গচ্ছা যাবে।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলদার বলেন, বাঁধকে টেকসই করতে বাঁধের নিকটবর্তী গর্ত ভরাটের প্রকল্প চলমান রয়েছে। এসব গর্তের কিছু কিছু জলমহালের আওতায় লীজ নেয়া। ইজারাদাররা গর্ত ভরাট করতে বাধা দিচ্ছেন। কয়েকটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে গর্ত ভরাট না করতে আমাদেরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আমরা এ বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা চেয়েছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা। কর্তৃপক্ষের তৎপরতায় হাওরের ঝুঁকিপূর্ণ গর্ত ভরাট প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হবে এমনটাই প্রত্যাশা কৃষকদের।