সড়কে প্রাণ গেল ১৪ নির্মাণ শ্রমিকের
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জুন ২০২৩, ৬:১৮:২৪ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার ॥ দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজারে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪ নির্মাণ শ্রমিকের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৪ জন। হতাহতদের সকলেই দরিদ্র পরিবারের। গতকাল বুধবার ভোরে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের কুতুবপুর এলাকায় আলু বোঝাই ট্রাক ও যাত্রীবহনকারী পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে এ ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে ৯ জন সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের, ৩ জন শান্তিগঞ্জ উপজেলার, একজন হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের এবং একজন নেত্রকোনার বাসিন্দা। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ও প্রিয়জনকে হারিয়ে অনেকেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। চালকের ঘুমিয়ে পড়া এবং অবহেলার কারণে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থা ধারণা করছে।
নিহতদের পরিচয় ॥ সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মৃত সজিব আলীর ছেলে রশিদ মিয়া (৫০), একই উপজেলার আলীনগর গ্রামের মৃত শিশু মিয়ার ছেলে হারিছ মিয়া (৬৫), সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মৃত মফিজ মিয়ার ছেলে সায়েদ নূর (৫০), দিরাই উপজেলার পাথারিয়া গ্রামের মৃত ছলিম উদ্দিনের ছেলে একলিম মিয়া (৫৫), গচিয়া গ্রামের বারিক উল্লার ছেলে সিজিল মিয়া (৫৫), ভাটিপাড়া গ্রামের সিরাজ মিয়ার ছেলে সৌরভ মিয়া (২৭), একই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের শমসের নুরের ছেলে মেহের (২৪), দিরাই উপজেলার মধুপুর গ্রামের সোনা মিয়ার ছেলে দুদু মিয়া (৪০), একই গ্রামের শাহজাহানের ছেলে বাদশা (২২), শান্তিগঞ্জ উপজেলার মুরাদপুর গ্রামের মৃত হারুন মিয়ার ছেলে দুলাল মিয়া (২৫), একই উপজেলার বাবনগাঁ গ্রামের মৃত ওয়াহাব আলীর ছেলে শাহিন মিয়া (৪০), একই উপজেলার তলেরতন গ্রামের মৃত আওলাদ উল্লার ছেলে আওলাদ হোসেন (৬০), হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার হলদিউড়া গ্রামের আব্দুর রহিমের স্ত্রী আমিনা বেগম (৪৫), নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার দশদার গ্রামের ইসলাম উদ্দিনের ছেলে আওলাদ মিয়া (৩০)। এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো অন্তত ১৪ জন। তারা ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হতাহতদের সকলেই ছিলেন নির্মাণশ্রমিক। গত বুধবার দুপুরেই পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে।
সিলেট মহানগর পুলিশের দক্ষিণ সুরমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামসুদ্দোহা জানান, ‘ মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা সিলেট অভিমুখী একটি আলুবোঝাই বড় ট্রাক (ঢাকা মেট্রো-ট ১৩-০৭৮০) ও দিনমজুরদের বহনকারী একটি পিকআপ (সিলেট-ন ১১-১৬৪৭) মুখোমুখি সংঘর্ষে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে ১১ জন মারা যান। ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ৩ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ১৪ জন।
উদ্ধার কার্যক্রমে ফায়ার সার্ভিস ॥ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে উপপরিচালক মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে সিলেট ফায়ার সার্ভিসের ৬টি টিম ঘটনাস্থলে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করে। সিলেট ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম ভূঞা বলেন, ‘নির্মাণশ্রমিক বহনকারী পিকআপ ওসমানীনগরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। নাজিরবাজার এলাকার কুতুবপুরে পৌঁছালে ঢাকা থেকে সিলেটগামী ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের পর শ্রমিক বহনকারী পিকআপটি সড়কের পাশে পড়ে যায় এবং বড় ট্রাকটি রাস্তায় দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
অপরদিকে সড়ক দুর্ঘটনার পর লাশগুলো সড়কে, সড়কের পাশে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। উদ্ধারকাজে নেতৃত্ব দেন ওসমানীনগরের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ওসমানীনগরের বেগমপুরে খুব ভোরে আরেকটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে গুরুতর আহতাবস্থায় একজনকে উদ্ধার করে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম। এ সময় আমাদের কাছে খবর আসে দক্ষিণ সুরমায় আরেকটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। বহু প্রাণহানির শঙ্কা আছে। ওই আহত ব্যক্তিকে নিয়েই ঘটনাস্থলে যাই।’
ফখরুল বলেন, ‘লাশগুলো সড়কের পাশে, সড়কের পাশে ঝোপের মধ্যে পড়ে ছিল। স্থানীয়দের সহযোগিতায় প্রথমে আহতদের উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্স করে হাসপাতালে নিয়ে আসি। এরপর একে একে লাশগুলো উদ্ধার করি।’
ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এরকম দুর্ঘটনা আগে দেখিনি। দুর্ঘটনাটি দেখে মনে হচ্ছে ট্রাকের চালক ঘুমিয়ে ছিলেন। যার জন্য এই দুর্ঘটনা। কারণ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সিলেটে আসা চালকেরা না ঘুমিয়ে ট্রাক চালিয়ে নিয়ে আসেন। এতে দুর্ঘটনার শঙ্কাও বেশি থাকে। আর এই দুর্ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে আলুবাহী ট্রাকটি ছিল খুবই দ্রুতগামী।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে নির্মাণ শ্রমিকদের বহনকারী পিকআপ ফখরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘পিকআপ ও ট্রাক মূলত মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সিলেট থেকে ওসমানীনগরে ঢালাই কাজে প্রায় ৩০ জন শ্রমিককে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তারা ছিলেন গাদাগাদি করে বসা। সেইসঙ্গে পিকআপে ছিল ঢালাই কাজের মিক্সার মেশিন, কোদাল, বেলচাসহ আরও অনেক যন্ত্রপাতি। মিক্সার মেশিনের ওপরও তিন-চার জন শ্রমিক বসা ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বলেন ॥ প্রত্যক্ষদর্শী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রবিউল ইসলাম বলেন, হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে একটি ট্রাক এসে আঘাত করলে আমাদের পিকআপ উল্টে যায়। ট্রাকটি সড়কের ডান পাশে চলে এসেছিল। একসময় একটি বিকট শব্দ হয়। এরপর কিছু বলতে পারিনি। দুর্ঘটনায় আমি আর বাবা আহত হলেও প্রাণে বেঁচে আছি। তবে আমার বড় চাচা আর নেই। তারা নগরীর আম্বরখানা এলাকা থেকে একটি পিকআপ নিয়ে ওসমানীনগরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন।
দুর্ঘটনার অপর প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহত সাজেদুরের ভাই শের ইসলাম (৫৫)। ভাইকে হারিয়ে আহাজারি করছিলেন তিনি। জানালেন, হঠাৎ করে বিপরীতমুখী একটি ট্রাক আমাদের দিকে ছুটে এসে ধাক্কা দেয়। মুহূর্তেই ল-ভ- হয়ে যায় আমাদের সবকিছু।
হাসপাতালের পরিবেশ ভারি ॥ দুপুরে লাশ হস্তান্তরকালে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আহত-নিহতদের স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠেছে হাসপাতালের পরিবেশ। হাসপাতালের হিমঘরের পাশে স্বজনদের ভিড় লেগে আছে। মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছেন তাদের অনেকে। এসময় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
অন্যদিকে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) ইমরুল হাসান জানান, নিহতদের মরদেহ গতকাল বুধবার দুপুরে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়না তদন্ত ছাড়াই ১৪ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
এসএমপি কমিশনার যা বলেন ॥ দুর্র্ঘটনার খবর পেয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ইলিয়াছ শরীফ দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি বলেন, পিকআপ করে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ। তারপরও মহাসড়কে পিকআপে করে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। একারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়-সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক থাকবো।
হাসপাতালে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী ॥ সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান সিলেট সফররত নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসাবে গতকাল বুধবার একাধিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সিলেট এসেছিলেন প্রতিমন্ত্রী। সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান এবং নিহতদের পরিবারকে সান্ত¦না দেন। এ সময় প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে সরকার থাকবে। সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।
জেলা প্রশাসন ও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর অনুদান ॥ সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: মজিবর রহমান বলেন, একসাথে ১৪ জনের প্রাণহানি একটি মর্মান্তিক ঘটনা। আমরা তাদের পাশে রয়েছি। তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে ও আহতদের পরিবারে ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে প্রদান করেন।